খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩০ শিক্ষকের একযোগে পদত্যাগ
ছবি সংগৃহিত
খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুকৃবি) ৩০ জন শিক্ষক একযোগে পদত্যাগ করেছেন। পদত্যাগকারী শিক্ষকদের মধ্যে ২০ জন বিভাগীয় প্রধান ও প্রভোস্ট-পরিচালক এবং ১০ জন শিক্ষক রয়েছেন। গত ৬ ডিসেম্বর তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বরাবর পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার খন্দকার মাজহারুল আনোয়ার শিক্ষকদের পদত্যাগপত্র পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। এর আগে শিক্ষকদের একটি অংশ গত ৪ ডিসেম্বর থেকে লাগাতার কর্মবিরতি শুরু করেন।
সোমবার (০৪ ডিসেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এসব শিক্ষকরা গতকাল মঙ্গলবার (৫ ডিসেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার খন্দকার মাজহারুল আনোয়ার বরাবর পদত্যাগ পত্র জমা দিয়েছেন। একইসঙ্গে কর্মবিরতি শুরু করেন। পৃথক পৃথক পদত্যাগপত্রে শিক্ষকরা সবাই স্বাক্ষর করেছেন। রেজিস্ট্রার মাজহারুল আনোয়ার বলেন, গত বুধবার শিক্ষকরা পদত্যাগ করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী ছাত্র হলের সহকারী প্রভোস্ট ও শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আমিসহ ৩০ জন শিক্ষক পদত্যাগ করেছি। প্রত্যেকে পৃথকভাবে পদত্যাগপত্র দিয়েছি। কিন্তু জমা দিতে গেলে অফিস থেকে তা গ্রহণ না করে পদত্যাগপত্রগুলো একত্র করে ফরওয়ার্ডিংসহ জমা দিতে আমাদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।’
পদত্যাগী শিক্ষকরা বলছেন, শিক্ষকদের একাংশের নিয়োগ সংক্রান্ত জটিলতার সমাধান, পদোন্নতি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার বাস্তবায়ন দাবিতে তারা গত ৬ ডিসেম্বর পদত্যাগ করেন। এর আগে ৪ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভায় পদত্যাগের এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পৃথক পদত্যাগপত্রে শিক্ষকরা সবাই স্বাক্ষর করেছেন। শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার খন্দকার মাজহারুল আনোয়ার বরাবর পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। এদিকে, শিক্ষকদের আন্দোলনে বিপাকে পড়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা। সেশনজটে পড়ার আশঙ্কা করছেন তারা।
জানা যায়, ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টিতে নিয়োগ-বাণিজ্য, অনিয়ম, শিক্ষকদের নিয়োগ বাতিলের নির্দেশ, সাবেক উপাচার্যের ছেলেমেয়ের চাকরিচ্যুতিসহ নানা কারণে সারা বছরই আলোচনায় ছিল দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। শিক্ষকদের পদোন্নতি এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন দেওয়ার দাবিতে গত ১৬ অক্টোবর থেকে কর্মবিরতি শুরু করেন শিক্ষক সমিতির প্রায় সব শিক্ষক। গত ৯ নভেম্বর তারা কর্মবিরতি প্রত্যাহার করেন।
গত ৬ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এতে উপাচার্যের স্বজনদের চাকরিচ্যুতিসহ ২৬ জন শিক্ষককে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেওয়া হয়। গত ১৮ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আশিকুল আলমের বিষয়ে তদন্ত কমিটি এবং অপর শিক্ষক মেহেদী আলমকে অব্যাহতি দেয়। মন্ত্রণালয়ের অন্য সিদ্ধান্তগুলো অনুমোদন করে সিন্ডিকেট।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি বলছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তাতে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার কোন কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে গত ১ বছরের বেশি সময় ধরে ঝুলে থাকা শিক্ষকগণের পদোন্নতি আরও দীর্ঘায়িত হবে। শিক্ষকদের আশংকা, শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের উক্ত নির্দেশনা দ্রুত বাস্তবায়নে কালক্ষেপন ও বৈষম্যে করা হচ্ছে। এতে শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের দেয়া শর্ত পূরণ হচ্ছে না এবং শিক্ষকগণের পদোন্নতি সমস্যা সমাধানের কোন সম্ভাবনাও দেখছে না।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আশিকুল আলম জানান, আমাদের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, আমরা ৭৩ জন শিক্ষক সেটা মেনে নিয়েছি। তারপরও শিক্ষকদের পদোন্নতি আটকে রাখা হয়েছে। উপাচার্য স্যার যদি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুমোদন দিয়ে দেন, তাহলেই জটিলতা কেটে যায়। কিন্তু সেটা করা হচ্ছে না।
দাবি আদায়ে পদত্যাগ করা শিক্ষক-কর্মকর্তারা হলেন- মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড পাবলিক হেলথ্ বিভাগের প্রধান মো. সালাউদ্দিন, ফিশারিজ বায়োলজি এন্ড টেকনোলজি বিভাগের প্রধান রাবেয়া আক্তার, এনাটমি বিভাগের প্রধান ড. নৌশিন জাহান, এগ্রিকালচারাল কেমিস্ট্রি বিভাগের প্রধান আবু রাশেদ মো. মওকিব, বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের প্রধান শরিফুল ইসলাম, ফিশারি রিসোর্সেস অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রধান সঞ্জীব কুমার বর্মন, এগ্রিকালচারাল ফাইন্যান্স, কো-অপারেটিভস অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের প্রধান সৌরভ মোহন সাহা, এনাটমি অ্যান্ড হিস্টোলজি বিভাগের প্রধান স্বরূপ কুমার কুণ্ডু।
ওশানোগ্রাফি বিভাগের প্রধান জেসমিন আরা, ক্রপ বোটানি বিভাগের প্রধান কেয়া আক্তার, এনিম্যাল সায়েন্স বিভাগের প্রধান মো. উজ্জ্বল হোসেন, সয়েল সায়েন্স বিভাগের প্রধান মো. জোনায়েত, সোসিওলজি অ্যান্ড রুরাল ডেভেলপমেন্ট বিভাগ প্রধান কাজী মৌসুমী আক্তার, এগ্রিকালচারাল ইকোনমিক্স বিভাগের প্রধান আনিকা তাহসিন মৌ, এগ্রিকালচারাল স্ট্যাটিস্টিক্স বিভাগের প্রধান হুমায়রা ইয়াসমিন, ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড কমিউনিকেশন স্টাডিজ বিভাগের প্রধান পূজা রায়, কৃষি শক্তি ও যন্ত্র বিভাগের প্রধান মোছা. সাবিনা আলীম, ফার্ম স্ট্রাকচার অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান গাজী তমিজ উদ্দিন, ফিজিওলজি বিভাগের প্রধান জান্নাতুল ফোরদৌস, পোল্ট্রি সায়েন্স বিভাগের প্রধান শারমিন জামান।
এছাড়া ওশানোগ্রাফি বিভাগের প্রভাষক ও ফিস হেলথ ম্যানেজমেন্ট বিভাগের বশির আহমেদ, ফিশারিজ অ্যান্ড কোয়ালিটি কন্ট্রোল বিভাগের ভাস্কর চন্দ্র মজুমদার তার সাময়িক ও প্রশাসনিক দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী ছাত্র হলের সহকারী প্রভোস্ট ড. মো. আসাদুজ্জামান, অস্থায়ী ছাত্রী হলের সহকারী প্রভোস্ট আতিয়া বিশ্বাস ও পাপিয়া খাতুন, ইন্টার্নাল কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স সেলের পরিচালক ড. নৌশিন জাহান, ফার্ম পাওয়ার অ্যান্ড মেশিনারিজ বিভাগের শিক্ষক ও পরিবহন পরিচালনা কমিটির আহ্বাবায়ক মো. তুহিনুল হাসান, অস্থায়ী ক্যাম্পাস ১-এর নিরাপত্তা কমিটির সদস্য জয়শংকর বৈদ্য, অস্থায়ী ক্যাম্পাস ২-এর নিরাপত্তা কমিটির সদস্য ভাস্কর চন্দ্র মজুমদার, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের রিচার্জ এণ্ড এডুকেশন সিস্টেমের সদস্য বিদ্যুৎ মাতুব্বর, অস্থায়ী ক্যাম্পাস ১-এর নিরাপত্তা কমিটির আহ্বায়ক স্বরূপ কুমার কুণ্ডু, অস্থায়ী ক্যাম্পাস ২-এর নিরাপত্তা কমিটির আহ্বায়ক শরীফুল ইসলামও পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন।
এদিকে, শিক্ষকদের আন্দোলনে বিপাকে পড়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা। সেশনজটে পড়ার আশঙ্কা করছেন তারা। শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে অবিলম্বে জটিলতা নিরসনে কার্যকর পদক্ষপ গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
উল্লেখ্য, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ১০৬ জন শিক্ষক, ৩৫০ জন শিক্ষার্থী এবং প্রায় ৩১০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। এর মধ্যে উচ্চশিক্ষা এবং মাতৃত্বকালীন ছুটিতে রয়েছেন প্রায় ২০ জন শিক্ষক। বাকিরা এখন দুই ভাগে বিভক্ত। অনেক শিক্ষক রোববার কর্মবিরতিতে সাড়া দেননি। মূলত সমিতির সাধারণ সম্পাদক আশিকুল আলমের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি হওয়ায় সাবেক উপাচার্যের অনুসারী শিক্ষকরা কর্মবিরতি শুরু করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আবুল কাশেম চৌধুরী বলেন, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের অনুমোদন সাপেক্ষে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা বাস্তবায়নে কাজ করছি। শিক্ষকের নিয়োগ সংক্রান্ত জটিলতা, শিক্ষকের পদোন্নতির এ বিষয়গুলো সাবেক উপাচার্যের আমলের। তবুও আমরা বিষয়গুলো সমাধানে কাজ করছি। কিছু বিষয় আদালতের প্রক্রিয়াধীন রয়েছেন। এর বাইরে যে বিষয়গুলো আছে, সেগুলো শিগগিরই সমাধান হয়ে যাবে।
একযোগে অন্তত ৩০ জন শিক্ষকের পদত্যাগের বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক আবুল কাশেম বলেন, তারা কীভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় পদত্যাগ করেছেন বা কেন পদত্যাগ করেছেন সেটা—আমাদের জানা নেই। এটা আপনারা অনুসন্ধান করে দেখতে পারেন, তাদের পদত্যাগপত্রে কে বা কারা স্বাক্ষর করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান জটিলতাগুলো সমাধানের পথে, এই মুহূর্তে তারা কার স্বার্থে পদত্যাগ করেছেন সেটিও আসলে সামনে আসা দরকার।