ঈদের আগে আরেক ঈদ
ঈদে মানে আনন্দ। ঈদ মানে উচ্ছ্বাস। ঈদের আনন্দ পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে চায় সবাই। তাই বাড়ি থেকে দূরে থাকা মানুষগুলো নাড়ির টানে ফিরে বাড়ি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও উচ্ছ্বাস ভরা মনে ঈদে আপন নীড়ে ফিরে। বছরজুড়ে বড় তিনটি বন্ধ পায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা ও দুর্গা পূজা। সবচেয়ে লম্বা বন্ধ মিলে ঈদুল ফিতরে।
পরিবার ছেড়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জীবনের লক্ষ্য বাস্তবায়নে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসে স্বপ্নবাজরা। সারা বছর সেমিস্টার পরীক্ষা, ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন, টিউশনসহ নানান ব্যস্ততায় যখন হাঁপিয়ে উঠে তখন জীবনকে কিছুদিনের জন্য বিশ্রাম দেওয়ার ফুরসত মিলে ঈদের ছুটিতে। এ যেন ঈদের আনন্দকে বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুণ। ঈদ উদযাপনে পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়াটা যেন ঈদের আগে আরেক ঈদ।
ছুটির দিন ঘনিয়ে আসতেই বাড়ির প্রতি মন টানতে থাকে শিক্ষার্থীদের। উৎকণ্ঠা হয়ে উঠে প্রতিটি স্বপ্নবাজ। কবে বাড়ির পথে পাড়ি দেবে, বাড়িতে গিয়ে রোজা শেষে ঈদটা কেমন হবে, পরিবারের সদস্যদের হাসিমুখ দেখার চিন্তায় রাতে যেন আর ঘুম আসতে চায় না। এভাবে নানান চিন্তা দানা বাঁধে মনে। একসময় আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। তলপি-তলপা গুছিয়ে হল কিংবা মেস ছেড়ে বাড়ির পথে পাড়ি জমায় তারা।
প্রথমবার এমন মুহূর্তের সম্মুখীন হওয়াটা কেমন? তা প্রকাশ করে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কিফায়াতুল হক বলেন, দূরে গিয়ে আরও কাছে আসা যায়, সেটা যে কতটা সত্য তা এবার অনুভব করছি বারংবার। এর আগে কখনো বাড়ি থেকে ওতদূরে থাকা হয়নি, তাই ঈদ উপলক্ষে বাড়িতে ফেরার অভিজ্ঞতা আমার কাছে সম্পূর্ণ নতুন। ট্রেনে যখন উঠলাম তখন অবচেতন মনেই বিড়বিড় করেছি 'স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার'। সেই ছোটবেলা থেকে গানটা শুনছি তবে এর গভীরতা অনুভব করলাম এই প্রথম। ছুটিতে বাড়ি এসে সব আগের মতো থাকলেও পরিবর্তন হয়েছে আমার দেখার দৃষ্টি। এখন আমি জানি এই ছুটি শেষ হবে, আবারও ফিরে যেতে হবে জীবন গড়ে তোলার লড়াইয়ে। তাই প্রিয়জনদের সঙ্গে কাটানো প্রত্যেকটা মুহূর্ত মনেপ্রাণে উপভোগ করার চেষ্টা লেগেই রয়েছে। বৃক্ষকে যেমন তার শেকড় শক্তি সঞ্চয় করে বাঁচিয়ে রাখে, এই স্মৃতিগুলোও তেমনি আমাকে সাহস যোগাবে। দীর্ঘ সময়ের জন্য পরিপুষ্ট রাখবে আমার হৃদয়।
দীর্ঘদিন পরিবার থেকে দূরে থেকে পরিবারের সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলোর অনুভূতি প্রকাশ করেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী সামিয়া টিনা। তিনি বলেন, ছোট থেকে বড় হয়েছি পরিবারের সঙ্গে। জীবনে প্রথমবারের মতো পরিবার ছাড়া ইফতার, সেহেরি করে কেমন যেন হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। অবশেষে যখন ছুটি পেলাম অনেক বেশি আনন্দের সঙ্গে বাড়ি ফিরলাম। বাড়ি ফেরার প্রতিটি মুহূর্তে কেমন যেন আবেগআপ্লুত হচ্ছিলাম। দীর্ঘ সময় পরিবার থেকে দূরে থেকে আবার কিছুদিনের মেহমান হয়ে পরিবারের সঙ্গে কাটানো সময়গুলোর মূল্য যেন অতুলনীয়।
ক্যাম্পাস বন্ধ হলেও অনেক শিক্ষার্থীকে টিউশনের কারণে বাড়ি ফিরতে হয়েছে দেরিতে। এ যেন ছুটির আনন্দের মাঝে এক দীর্ঘশ্বাস। প্রতিদিন ফাঁকা হতে থাকে ক্যাম্পাস। মন যেন আর টিকতেই চায় না তাদের। শূন্য ক্যাম্পাসে থাকার রিক্ত অনুভূতি তুলে ধরেন শেখ হাসিনা হলের আবাসিক শিক্ষার্থী রুমা আক্তার।
তিনি বলেন, আস্তে আস্তে হল খালি হতে থাকে। রুমমেট, ক্লাসমেট সবাই এক এক করে চলে যায়। আমরা যারা টিউশন করাতাম এ কয়েকজন থেকে যায়। যত দিন যায় ক্যাম্পাস তত খালি হতে থাকে। মনে বারবার বেজে উঠে বাড়ি কবে যাব। যেতে পারলেই যেন এ ধরাবাঁধা জীবন থেকে হাফ ছেড়ে বাঁচি। এভাবে অপেক্ষার প্রহর গোনা শেষে বাড়িতে আসতে পারাটা সত্যি অনেক আনন্দের। মায়ের মুখ দেখে তার হাতের সেহেরি খেয়ে রোজা রাখতে পারাটা পরম মায়ার। এর চেয়ে বেশি আনন্দ আর হয় না।
এভাবে প্রতিবছর ঈদে সোনালী মুহূর্ত কাটাতে নিজ নিজ জেলায় পরিবারের কাছে ফিরে যায় কুবির স্বপ্নবাজ তরুণ-তরুণীরা। প্রতি ঈদে বাড়ি ফেরার গল্পের সঙ্গে একধাপ এগিয়ে যোগ হয় নিজেদের জীবনের লক্ষ্য পূরণের গল্প।
সবাই যখন বাড়িতে ফিরে যাচ্ছে তখন গুটি কয়েক শিক্ষার্থী থেকে যাচ্ছে ক্যাম্পাসে। কেন থাকছে এবং তাদের সার্বিক বিষয়ে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হলের প্রভোস্ট সহযোগী অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, অনেক শিক্ষার্থী আছে যারা দূর-দূরান্ত থেকে আসে তাই বাড়িতে যেতে চায় না আর্থিক কারণে, আবার অনেকের পরীক্ষা থাকে ঈদের পরেই, তারাও যায় না। সনাতন ধর্মালম্বীরাও যায় না বাড়িতে। এর ফলে এখনো কিছু শিক্ষার্থী হলে অবস্থান করছে। কিন্তু এসব বন্ধে তারা প্রশাসন থেকে কোনো সুবিধা পাবে না এটা নোটিশে বলে দেওয়া হয়েছে। তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব সম্পূর্ণ নিজেদের। তবে আমরা নিজেদের দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় তাদের বিষয়ে খবরাখবর নিই।
এসজি