কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই কোনো প্রতিষ্ঠাকালীন স্মৃতি
২০০৬ সালের ২৮মে কুমিল্লার কোটবাড়ি এলাকায় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্ভোদন করেন ততকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। ৫০ একর জমির উপর একটি একাডেমি ভবন, প্রশাসনিক ভবন ও তিনটি হল নিয়ে যাত্রা শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়। অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনগুলোতে নেই কোনো প্রতিষ্ঠাকালীন ছাপ। অপরদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত ভিত্তিপ্রস্তর এবং প্রতিষ্ঠাকালীন ফটক ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে অভ্যন্তরীণ রাস্তা সংস্কার ও মহাসড়কের সাথে আন্ডারপাস নির্মাণে। তিন বছর আগে ভেঙ্গে ফেলা ভিত্তিপ্রস্তরের হদিস জানেনা প্রশাসন।
এসব পুনঃস্থাপনের কোনো উদ্যোগ নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ। এ জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার দপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০০৬ সালে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর কতৃক পাঁচ তালা একটি প্রশাসনিক ভবন, তিন তালা দুইটি ছেলেদের হল, একটি মেয়েদের হল ও অ্যাকাডেমিক ভবন নির্মাণ করা হয়। পরে হলগুলো ও অ্যাকাডেমিক ভবন দুই তালা বাড়িয়ে পাঁচ তালা করা হয়।
বিভিন্ন সময় আরো নতুন তিনটি অ্যাকাডেমিক ভবন, দুইটি হল, ভিসি বাংলো, ডরমেটরি, ক্যাফেটেরিয়া, গেস্টহাউজ নির্মাণ করা হয়। ২০১৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও ২০১৭ সালে বঙ্গব›ধুর ভার্ষ্কায নির্মাণ করা হয়। যার একটিও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্টাকালীন স্মৃতি বহন করেনা।
অপরদিকে ২০০৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূলফটকের মুখে ভিত্তিপ্রস্তর ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বেলতলী বিশ^রোড়ের মুখে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটক স্থাপন করে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর। এ দুটি ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্টাকালীন স্মৃতি। যাতে উল্ল্যেখ ছিলো বিশ্ববিদ্যালয় কখন ও কোথায় প্রতিষ্টা হয়েছে এবং প্রতিষ্টার পিছনে কার কার অবদান ছিলো।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৯ সালে মূলফটক থেকে শহীদ মিনার পর্যন্ত পাকা রাস্তা নির্মাণে ভেঙ্গে ফেলা হয় ভিত্তপ্রস্তরটি। তৎকালীন প্রশাসন জানায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ রাস্তা সম্প্রসারণ এবং সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য ভিত্তিপ্রস্তরটি ভাঙা হচ্ছে। যা পুনঃস্থাপন করা হবে। কিন্তু রাস্তা নির্মাণের ৩ বছর পার হলেও পুনঃস্থাপন করা হয়নি ভিত্তিপ্রস্তরটি। এমনকি খোঁজ নিয়েও ভিত্তি প্রস্তরের নামফকের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।
কোথায় গেলো ভিত্তিপ্রস্তরের নামফলক
রাস্তা নির্মাণের দায়িত্বে থাকা সহকারী প্রকৌশলী মোঃ বিল্লাল হোসের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় তখন তিনি অসুস্থ থাকায় কাজ দেখতে আসতে পারেননি। ভিত্তিপ্রস্তরটি ভেঙ্গে নাম ফলকটি কোথায় জমা দেওয়া হয়েছে তা তিনি সুস্পষ্ট জানেন না, তবে উন্নয়ন ও পরিকল্পনা দপ্তরে থাকতে পারে বলে ধারণা করেন।
উন্নয়ন ও পরিকল্পনা দপ্তরের উপ-পরিচালক ড.মোঃ শাহাবুদ্দিনের কাছে এ বিষয়ে খোজ নিলে তিনি জানান, ভিত্তি প্রস্তরের নাম ফলকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টোর শাখায় জমা দেওয়া হয়েছে। স্টোর শাখায় খোঁজ নিয়েও তার কোনো হদিস মেলেনি। স্টোর শাখা থেকে জানানো হয় দপ্তর বা বিভাগ থেকে কোন জিনিস গ্রহণ করলে তার কাগজ হয়ে থাকে, কিন্তু ভিত্তিপ্রস্তরের নাম ফলক সংগ্রহের কোন কাগজ পাওয়া যায়নি।
ভিত্তিপ্রস্তর পুনঃস্থাপন না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করে একাধিক শিক্ষার্থী
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাজিব বলেন, ভিত্তি প্রস্তর কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্তিত্বের সাথে জড়িত। যদি কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য না থাকে, রাস্তা নির্মাণের কাজে ভাঙ্গা হলেও প্রশাসন এতদিনে স্থাপন করেনি কেনো? আর তা যদি হদিস না মেলে এ বিষয়ে প্রশাসনের গাফিলতি। আগামীতে যারা কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে এবং দেখতে আসবে তারা কিভাবে বুঝবে, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম কোথায় স্থাপিত হয়েছিলো।
বর্তমানে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে দেড় কিলোমিটার দুরে নতুন করে ২০০ একর জমির উপর নতুন ক্যাম্পাস নির্মাণ করা হচ্ছে। সকল অনুষদ, প্রশাসনিক ভবন এবং হল সহ অন্যান্য ভবন গুলো নতুন করে নির্মিত হচ্ছে। যার কারণে সর্বপ্রথম কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস কোথায় স্থাপিত হয়েছে আগামীতে শিক্ষার্থীদের মনে এ নিয়ে দন্দ তৈরি হওয়ার আশংকা করছে সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে উপাচার্য ড.এ এফ এম আব্দুল মঈন বলেন, আগের উপাচার্যের সময় তা ভাঙ্গা হয়েছে তাই আমি এ বিষয়ে কিভাবে কি হয়েছে ঠিক বলতে পারবো না। ফাইল দেখে খোঁজ নিয়ে জানাতে হবে।
ভেঙ্গে ফেলা হলো ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে প্রতিষ্ঠাকালীন ফটক
ভিত্তি প্রস্তর ছাড়াও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন স্মৃতির মধ্যে রয়েছে প্রতিষ্ঠাকালীন ফটক। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বেলতলী বিশ্বরোড এলাকায় সরকারি জায়গার উপর ২০০৬ সালে ফটকটি নির্মাণ করা হয় এ ফটক। ততকালীন শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর এ ফটক নির্মাণ করে দেয়। কিন্তু বেলতলী বিশ্বরোড এলাকায় আন্ডারপাস নির্মাণে ভেঙ্গে ফেলা হয় ফটকটি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বছরের ২৮ জুলাই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় বেলতলীসহ কুমিল্লার বিভিন্ন স্থানে তিনটি আন্ডারপাস ও একটি ইউলুপ নির্মাণের জন্য একটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। ওই প্রকল্পের আওতায় সম্প্রতি বেলতলীতে আন্ডারপাস নির্মাণের জন্য কাজ শুরু করা সড়ক ও জনপদ উন্নয়ন অধিদপ্তরের (সওজ) তথ্য মতে, মহাসড়কের পাশে অবস্থিত কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান ফটকটি সওজের অধিগ্রহণকৃত ভূমিতে নির্মাণ করা হয়েছিল। সেখানে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক অপসারণ করা ছাড়া আন্ডারপাস নির্মাণ সম্ভব নয়।
বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সাঙ্গে মিটিং করেছে সড়ওক ও জনপদ অধিদপ্তরের (সওজ) প্রতিনিধিরা। সভা শেষে সওজকে আরেকটি ফটক নির্মাণের দাবি জানিয়েছে কুবি কর্তৃপক্ষ। আরেকটি ফটক নির্মাণ করে দিতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিঠি দিয়েছে বলে নিশ্চিত করে রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) মো. আমিরুল হক চৌধুরী।
এ বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড.এফএম আবদুল মঈনের সাথে কথা বললে তিনি প্রকৌশল দপ্তররে খোঁজ নিতে বলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সওজ কতৃক একটি চিঠিতে জানানো হয়, ২৬শে অক্টোবর ২০২২ তারিখে যোগাযোগ মন্ত্রনালয়ের স্টিয়ারিং কমিটির সভায় কুবির গেইটটি করে দেওয়ার আবেদন করা হয়।
সভায় সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তরকে (সওজ) ডিপিপি (৫৬৮ কোটি ৯৩ লক্ষ টাকার বাজেট) যথাযথ যুক্তি সাপেক্ষ প্ল্যান রিভাইজ (ব্যায় বৃদ্ধি) করে পাঠানোর অনুমতি দেয় যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে। প্ল্যান রিভাইজের বিষয়ে সওজ, কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটক ছাড়াও আরো কয়েকটি জায়গায় ভূমি অধিগ্রহণ করতে হবে। তাই ভূমির দাম ঠিক করে পুরোটা একেবারে রিভাইজ করে জমা দিবো।
প্রশাসনের অনীহা
শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে গুঞ্জন রয়েছে ভিত্তি প্রস্তরের নাম ফলকে বেগম খালেদা জিয়ার নাম ও ফটকে বেগম খালেদা জিয়ার নামসহ আরো ততকালীন ১৫ জন সংসদ সদস্যের নাম থাকায় তা পুনঃস্থাপনে প্রশাসনের অনিহা রয়েছে।
এ বিষয়ে সাদা দল সমর্থিত শিক্ষক ড. মো. আবদুল হাকিম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পিছনে যার অবদান থাকুক কোনো রাজনীতিকরনের কারনে যেন সরিয়া ফেলা ঠিক নয়। এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত। আমি অনুরোধ করবো উপাচার্য কে তিনি যেনো ভিত্তিপ্রস্তর এবং বেলতলীর ফটকটি পুনঃস্থাপনে উদ্যোগ নেয়।
এর আগে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে প্রধান ফটকে থাকা বেগম খালেদা জিয়া এবং বিএনপি সরকারের মন্ত্রীদের নামফলকের মুছে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ।
ভিত্তি প্রস্তর ও ফটক পুনঃস্থাপন নিয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সদস্য সচিব মোস্তাফিজুর রহমান শুভ বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি, রেজিস্ট্রার ও ছাত্রলীগ যৌথভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নাম সংকলিত ভিত্তিপ্রস্তর ভেঙ্গে ফেলেছে।
আমরা তাৎক্ষণিক ভিসির কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, ভেতরের রাস্তা প্রশস্ত করতে সাময়িকের জন্য ভিত্তিপ্রস্তরটি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিন বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো ভিত্তিপ্রস্তরটি প্রতিস্থাপন করা হয়নি। এখন প্রতিষ্ঠাকালীন ফটকটিও ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। পুনঃস্থাপন হবে কিনা এ বিষয়ে আমাদের আশঙ্কা রয়েছে। আমি ভিসি স্যারকে দ্রæত সময়ের মধ্যে ভিত্তিপ্রস্তর ও ফটকটি পুনঃস্থাপনে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহনে অনুরোধ করছি।'
বিশ্ববিদ্যালয়ের এ স্থাপনা দুটি পুনঃস্থাপনের বিষয়ে জানতে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড.মোঃ হুমায়ুন কবির জানান, উপাচার্য মহোদয় ফটকটি পুনঃস্থাপনে যথেষ্ট চেষ্টা করছেন। আর ভিত্তি প্রস্তর পুনঃস্থাপনে কি যেতে পারে এ বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে।
এএজেড