ঢাবি ছাত্রলীগের সাদামাটা সম্মেলন, নেতৃত্বের দৌড়ে এগিয়ে যারা
প্রায় সাড়ে চার বছর বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলেও ঘোষণা করা হয় নি কমিটি।
আগামী ৬ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলনের পর কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ এবং মহানগরের (উত্তর-দক্ষিণ) কমিটি ঘোষণা করা হবে। জানা গেছে, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ এ ইউনিটে ২৪৫ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র গ্রহণ ও জমা দিয়েছেন।
শেষ পর্যায়ে মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। এদিকে শেষ সময়ে এসেও পদপ্রত্যাশীরা আওয়ামী লীগের উচ্চ মহল থেকে শুরু করে সিনিয়র নেতাদের লবিংয়-তদবিরে দৌড়-ঝাপ করছেন, বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই পদের বিপরীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হল, অনুষদ, ইনস্টিটিউট, শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক এবং ঢাবি ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটির পদপ্রাপ্তরা প্রার্থী হয়েছেন।
উৎসবমুখর ও সাদা-মাটা সম্মেলন
২০১৮ সালের ২৯ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মেলন হয়। সম্মেলনের আড়াই মাস পর ৩১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা করা হয়। এতে দায়িত্ব পায় সনজিত চন্দ্র দাস ও সাদ্দাম হোসেন। ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই এক বছর মেয়াদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের দায়িত্ব নেওয়ার পর পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতেই প্রায় ১০ মাস সময় নিয়েছেন সনজিত-সাদ্দাম। হল কমিটিগুলো করেছেন মেয়াদ শেষ হওয়ার আড়াই বছর পর।
দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলে আয়োজিত হয়নি ঢাবি ছাত্রলীগের সম্মেলন। চার বছর পর সম্মেলন পেয়ে নেতা-কর্মীদের মাঝে উচ্ছ্বাসেই যেন মেতে ছিল পুরো সম্মেলন জুড়ে।
মাস্টার দ্য’ সূর্য সেন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের কলা অনুষদে দপ্তর সম্পাদক আরিফুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘদিন পর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। নেতা-কর্মীসহ সকলের মাঝে উচ্ছ্বাস। এখন শুধু আপেক্ষার পালা কারা আসছেন এ শীর্ষ দু’ পদে। আশা রাখি, যোগ্য ও দেশরত্ন শেখ হাসিনার স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করতে পারেন এ দক্ষ নেতৃত্ব আসবে।
সাদা-মাটা সম্মেলন পালন করল ঢাবি ছাত্রলীগ। সম্মেলন শেষে ছিল না কোনো কনসার্টের আয়োজন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশের কারণে ব্যয় সাশ্রয়ী সম্মেলন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ। এমনটাই সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন, ঢাবি ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন।
এ ছাড়া, সম্মেলনে ছিল না কোনো ব্যানার-প্লাকার্ড-ফেস্টুন। ক্যাম্পাসের একাডেমিক পরিবেশ রক্ষার্থে সম্মেলনের একদিন আগেই ব্যানার-প্লাকার্ড-ফেস্টুন খুলে ফেলার নির্দেশ দেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ। বিষয়টি অনেকেই ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে ঢাকাপ্রকাশ-এর কথা হলে তারা জানান, বিষয়টি অনেক ভাল। ক্যাম্পাসের পরিবেশ রক্ষায় অন্যান্য ছাত্রসংঘঠনগুলোও এটি অনুসরণ করতে পারে।
আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, পদপ্রত্যাশীদের মধ্যে যাদের সাংগঠনিক সক্ষমতা ভালো রয়েছে ক্লিন ইমেজ এবং যাদের পরিবারের সঙ্গে জামায়াত-বিএনপির কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই, শিক্ষার্থীদের কাছে জনপ্রিয় এবং মানবিক কাজে করে আলোচনায় আসতে পেরেছেন তারাই আগামীর নেতৃত্বে আসবে।
নতুন নেতৃত্বের কাছে গঠনতন্ত্র অনুসরণের প্রত্যাশা
গত ৪১ বছরে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ইউনিটগুলোতে এক বছর পরপর কমিটি হলে ৪১টি কমিটি হওয়ার কথা, সেখানে হয়েছে মাত্র ১২টি। কর্মীদের প্রত্যাশা সামনে যারা নেতৃত্বে আসবে, আশা করি সামনের নেতৃত্বগুলোতে এমন জটিলতা ঘুচে যাবে।
নাম প্রকাশে সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ছাত্রলীগের এক কর্মী বলেন, শীর্ষ নেতারা অনেক সময় গড়ি-মসি করেন নতুন সম্মেলন করে কমিটি দিতে। তারা নিজের কথা না ভেবে যদি সংগঠনের কথা ভেবে নতুনদের নেতৃত্বে আসার রাস্তা সহজ করে দিলে হয়তো মেধাবী অনেক মুখ চলে আসবে। নিয়মিত সম্মেলন-কমিটি না দেওয়ায় অনেক মেধাবী-পরিশ্রমী মুখ ঝরে পড়ে যায়।
১৯৮১ সালের পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন খলিলুর রহমান মোহন-আতাউর রহমান ডিউক (১৯৮১-১৯৮৩), আহ্বায়ক মকবুল হোসেন খান (১৯৮৩-১৯৮৫), মনিরুজ্জামান বাদল-মমতাজ উদ্দিন মেহেদী (১৯৮৬-১৯৮৮), গোলাম মোস্তফা সুজন-কামরুজ্জামান আনসারী (১৯৮৮-১৯৯২), খিজির হায়াত লিজু-পংকজ দেবনাথ (১৯৯২-১৯৯৪), বাহাদুর বেপারি-আবদুল ওয়াদুদ খোকন (১৯৯৪-১৯৯৮), সাজ্জাদ হোসেন/বেগ শাহীন জাহান (ভারপ্রাপ্ত) এ কে এম আজিম (১৯৯৮-২০০২), দেলোয়ার হোসেন-হেমায়েত উদ্দিন খান হিমু (২০০২-২০০৬), শেখ সোহেল রানা টিপু-সাজ্জাদ সাকিব বাদশা (২০০৬-২০১১), মেহেদী হাসান মোল্লা-ওমর শরীফ (২০১১-২০১৫), আবিদ আল হাসান-মোতাহার হোসেন প্রিন্স (২০১৫-২০১৮), সনজিত চন্দ্র দাস-সাদ্দাম হোসেন (২০১৮-২০২২)।
দেখা গেছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই পদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো থেকে শীর্ষ পদগুলোর নেতৃত্বে আসে। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটবে না, বলে ধারণা করা হচ্ছে।
শীর্ষ দুই পদে আলোচনায় যারা
বিজয় একাত্তর হলের সাধারণ সম্পাদক আবু ইউনুস, সূর্যসেন হলের সাধারণ সম্পাদক সিয়াম রহমান, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাসিবুল হাসান শান্ত, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল শাখার সভাপতি তানভীর শিকদার, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের সভাপতি কামাল উদ্দীন রানা, হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলের সভাপতি শহিদুল হক শিশির ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হোসেন, ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ হলের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম জাহিদ, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হল শাখার সভাপতি মেহেদি হাসান শান্ত, স্যার এ এফ রহমান হল ছাত্রলীগের সভাপতি রিয়াজুল ইসলাম এবং ফজলুল হক হলের সভাপতি আনোয়ার হোসাইন নাইম।
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সমাজসেবা বিষয়ক উপ-সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত, সাহিত্য বিষয়ক উপ-সম্পাদক জয়দ্বীপ দত্ত (জয়জিৎ), নাট্য ও বিতর্ক বিষয়ক সম্পাদক ফয়সাল মাহমুদ, সহ-সম্পাদক দিদারুল আলম, এস এম রাকিব সিরাজী, ঢাবি ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম সবুজ তালুকদার ও সাংগঠনিক সম্পাদক জহিরুল ইসলাম।
এদিকে বেশ কয়েকজন নারী নেতাও আলোচনায় রয়েছেন। তারা হলেন-কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ফরিদা পারভীন, তিলোত্তমা শিকদার, উপ-সাহিত্য বিষয়ক সম্পাদক ফাল্গুনী দাস তন্বী এবং মুক্তিযুদ্ধ ও গবেষণা বিষয়ক উপ-সম্পাদক রওনক জাহান রাইন।
শেষ বেলায় কী বললেন নেতারা
সম্মেলনে ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় বলেন, ২৪৫ জনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা রাখে। ধাপে ধাপে নেতৃত্বের বহিঃপ্রকাশ হয়; প্রথম বর্ষ থেকে শুরু করে মাস্টার্স পর্যন্ত একটি সুশৃঙ্খল নিয়মনীতির ভেতর বাংলাদেশ ছাত্রলীগ পরিচালিত হচ্ছে। আজ এই সম্মেলনের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ যোগ্য নেতৃত্ব পাবে। যারা আগামীর বাংলাদেশ ও চতুর্থ বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য যোগ্য নেতৃত্ব আসবে, বলে প্রত্যাশা রাখি।
সম্মেলনে প্রধান বক্তা ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য বলেন, চার বছর পরে ঢাবি ছাত্রলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই চার বছরে ঢাবি ছাত্রলীগের কর্মীরা তাদের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ চর্চা করার সুযোগ পেয়েছে, শেখ হাসিনার নির্দেশনাগুলো মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করার সুযোগ পেয়েছে। এ সময় তিনি করোনাকালীন ছাত্রলীগের কর্মীদের নিজ নিজ জায়গা থেকে সংগঠনের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করায় ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
সভাপতির বক্তব্যে সদ্য বিলুপ্ত ঢাবি ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস বলেন, শেখ হাসিনা আমাদের হাতে যে আমানত তুলে দিয়েছিলেন তা আমরা পালন করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। যত দোষত্রুটি এবং ব্যর্থতা রয়েছে সেটি আমার ও আমার সাধারণ সম্পাদকের কাঁধে নিতে চাই। আর যত সফলতা, যত শিক্ষাবান্ধব কার্যক্রম সেগুলো আমরা শেখ হাসিনা এবং ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে দিতে চাই।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, চিন্তার কোনো কারণ নেই। আগামী ৬ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলনের পর কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ এবং মহানগরের (উত্তর-দক্ষিণ) কমিটি ঘোষণা করা হবে। আমরা সিভি নিচ্ছি, যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
এমএমএ/