মারধর ও টাকা নেবার পর পরীক্ষা না দিয়ে বাঁচলেন আল-আমিন
লেখা ও ছবি : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি।
মারধরের শিকার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য ও হিসাববিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আল-আমিন ক্যাম্পাস ছেড়ে বাড়ি চলে গেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বৃহস্পতিবার, ২৫ আগষ্ট তিনি কুরিয়ারে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
আল আমিনের অভিযোগ অনুযায়ী, ১৭ আগস্ট তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে আটকে রেখে তিন ঘণ্টার বেশি সময় ধরে নির্যাতন করেছেন ছাত্রলীগের দুই নেতা।
পরে তারা তার ছাত্রের ডেবিট কার্ড থেকে ৪৫ হাজার টাকাও তুলে নিয়েছেন।
বর্তমানে তাকে বিভিন্ন মাধ্যমে হুমিকি দেওয়া হচ্ছে।
যার কারণে তিনি কুরিয়ারে এই অভিযোগপত্র পাঠিয়েছেন।
ভুক্তভোগী মো. আল-আমিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য ও হিসাববিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র।
বাড়ি শরীয়তপুর সদর উপজেলায়। তার চতুর্থ বর্ষের প্রথম সেমিস্টারের চূড়ান্ত পরীক্ষা চলছে।
১৭ আগস্ট ছিল প্রথম পরীক্ষা।
অভিযোগপত্র পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. আসাবুল হক।
তিনি বলেন, ‘কুরিয়ারের মাধ্যমে একটি অভিযোগ এসেছে। এ ঘটনা তদন্তে আমরা একটি কমিটি করেছি।’
অভিযোগপত্রে আল-আমিন আরো জানান, তিনি ১৭ আগস্ট পরীক্ষায় অংশ নেন।
বিকেল সাড়ে চারটায় পরীক্ষা শেষে বের হওয়ার পরপরই বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সুরঞ্জিত প্রসাদ বৃত্ত ও মতিহার হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ভাস্কর সাহা তাকে রবীন্দ্রভবন থেকে বঙ্গবন্ধু হলের ৩৩১ নম্বর কক্ষে নিয়ে যান। কিছুক্ষণ পর সেখানে মুমিনুর রহমান, ফয়সাল আহমেদ ওরফে শশীসহ কয়েকজন আসেন। মুমিনুর তার মাথায় দুই লিটার পানির বোতল ঢেলে দেন। লাঠি দিয়ে আঘাত করেন। তিনি একপর্যায়ে অচেতন হয়ে যান। এ সময় তাঁর মুঠোফোন থেকে ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নেন তারা। জ্ঞান ফেরার পর রাত আটটার দিকে জোরপূর্বক তার ডেবিট কার্ড নিয়ে গিয়ে ৪৫ হাজার টাকা তোলেন সুরঞ্জিত প্রসাদ বৃত্ত ও ভাস্কর সাহা।
অভিযোগের বিষয়ে ছাত্রলীগের মুমিনুর রহমান বলেন, আল-আমিনসহ আরও কয়েকজনকে তাদের দুরবস্থার সময় তিনি চাকরি দিয়েছিলেন। এক-দেড় বছর চাকরি করার পর আল-আমিন বললেন, তিনি বিসিএস পরীক্ষা দেবেন। আল-আমিন চলে যান। কিন্তু তারা কয়েকজন গিয়ে আরেকটি কোম্পানি খোলেন। সেখানে তার কোম্পানির ক্লায়েন্টদের নিচ্ছেন তারা। এতে তার ১০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ নিয়ে তারা ১৭ আগস্ট সুরাহার জন্য কথা বলতে বসেছিলেন। আল-আমিনকে কেউই মারধর করেননি বলে জানিয়েছেন তিনি।
আল-আমিনকে মারধার ও টাকা নেয়া ফয়সাল আহমেদ শশী অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘আল-আমিন দেড়- দুই বছর ধরে আমাদের কোম্পানিতে চাকরি করত। সে ক্লায়েন্টের সঙ্গে সরাসরি কাজ করত। এই সুযোগে সে অনেক ক্লায়েন্টকে কোম্পানি সম্পর্কে ভুল তথ্য দিয়ে টাকা আত্মসাৎ করে নিজের অ্যাকাউন্টে নিয়েছে। শুধু তাই নয় তারা ক্লায়েন্টকে ভুল তথ্য দিয়ে সেম টাইপের আরেকটি প্রতিষ্ঠান করছে। আমাদের প্রায় ৭শ’র মত ক্লায়েন্টকে ভুল তথ্য দিয়ে তাদের কাছ থেকে থেকে প্রায় দশ কোটি টাকা নিয়েছে। এ নিয়ে আমাদের আইনী প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। আমাদের কোম্পানির আইনী পরামর্শক আছেন, তার দিক-নির্দেশনা মত আমরা আগাচ্ছি।’
৪৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়ে মুমিনুর রহমান বলেন, ‘সুরঞ্জিত প্রসাদ বৃত্ত ও ভাস্কর সাহা আলোচনার সময় ছিলেন। কিন্তু পরে কী হয়েছে, এটা বলতে পারব না।’
আল আমিন জানান, মার্কেটিং বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের মুমিনুর রহমান, ফয়সাল আহমেদ শশী ও তাকি আহমেদের সঙ্গে কয়েক মাস ফ্রিল্যান্সিং ‘ডিজিটাল মার্কেটিং’-এর কাজ করেছিলেন। মনোমালিন্য হওয়ায় বছরখানেক আগে তিনি কাজ ছেড়ে দেন। এ কাজের জন্য তাদের সঙ্গে কোনো চুক্তিপত্র ছিল না। তারা জোরপূর্বক মিথ্যা জবানবন্দি দিতে বাধ্য করেছেন ও ভিডিও ধারণ করেন। হুমকি দিয়ে বলেন, তাদের কথার বিপক্ষে কোনো কথা বললে ও কোনো পদক্ষেপ নিলে মেরে ফেলা হবে। তাই তিনি জীবন বাঁচানোর জন্য তারা যা বলেছেন, তাই করেছেন।
আল-আমিন অভিযোগে আরও উল্লেখ করেছেন, তাকে ভয় দেখিয়ে স্ট্যাম্প পেপারে স্বাক্ষর নেওয়ার চেষ্টা করেন তারা। কিন্তু তার বোন জাতীয় জরুরি নম্বরে (৯৯৯) কল করার পর পুলিশ আসায় স্বাক্ষর নিতে পারেননি। ওই হলে অন্য একটি ঘটনায় সাংবাদিক, পুলিশ ও অন্যরা এলে রাত নয়টার দিকে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সে রাতেই জীবন বাঁচাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা অসম্পূর্ণ রেখে শরীয়তপুরে চলে যান। এখনো তাকে হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে।
আল-আমিন বলেন, তাদের কাছে তার পরীক্ষার প্রবেশপত্র আছে। তিনি ভয়ে আছেন। রাজশাহীতে আসতে পারছেন না। তাকে নিয়মিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ফলে তিনি কুরিয়ারের মাধ্যমে অভিযোগ পাঠিয়েছেন। এ ঘটনার বিচার চান তিনি।
টাকা নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে ছাত্রলীগ নেতা সুরঞ্জিত প্রসাদ বৃত্ত বলেন, মার্কেটিংয়ের সাবেক শিক্ষার্থী মুমিনুরের সঙ্গে আল-আমিনের আইটি ফার্ম নিয়ে সমস্যা ছিল। এজন্য মুমিন ক্যাম্পাসে এসে ওই ছেলেকে আটক করে। পরে বিষয়টি আমি জানতে পেরে বঙ্গবন্ধু হলে যাই। সেখানে মিউচ্যুয়ালের জন্য আমরা একসাথে বসি। কিন্তু মুমিন তাকে পুলিশে দিয়ে দেওয়ার কথা বলছিল। পরবর্তীতে আমি বিষয়টি রুনুকে (রাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক) জানাই। রুনু আল-আমিনের বিভাগের শিক্ষক ও সহকারী প্রক্টর সুমন স্যারের সঙ্গে কথা বলেন। সুমন স্যার ওই শিক্ষার্থীকে পুলিশে না দিতে অনুরোধ করেন। নিজেদের মধ্যে সমাধান করে নিতে বলেন। পরবর্তীতে রুনুসহ আমরা বসে বিষয়টি সমাধান করি। এখানে টাকা নেওয়া বা মারধরের প্রশ্নই আসে না।
প্রসঙ্গত, সুরঞ্জিত প্রসাধন বৃত্ত ও ভাস্কর সাহা রাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনুর অনুসারী।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনু বলেন, ‘মুমিন ও শশীর অধীনে আল-আমিন মূলত একটা চাকরি করত। চাকরি সূত্রে তাদের কিছু ডকুমেন্ট সরিয়ে নেয় আল-আমিন। তাই তারা আর্থিকভাবে অনেক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এ বিষয়টি জানালে আমি আলা-আমিনের সঙ্গে কথা বলি এবং সে স্বীকার করে তার জন্য কিছু ক্ষতি হয়েছে। তবে ক্ষতির পরিমাণ যতটা সম্ভব পূরণের বিষয়ে সম্মত হয় আল-আমিন। এখানেই বিষয়টা শেষ হয়ে যায়। কিন্তু পরবর্তীতে এত দিন পর সে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে আমার অনুসারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে। তার কাছ থেকে টাকা নেয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা।’
ছবি : ছবিটি প্রতীকী-রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার।
ওএফএস।