অতিরিক্ত ভারে নড়বড়ে জাবি প্রশাসন
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) বিভিন্ন প্রশাসনিক পদ সাময়িক, চুক্তি ও ভারপ্রাপ্তদের দিয়েই নড়বড়ে অবস্থায় পরিচালিত হচ্ছে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট-১৯৭৩ অনুযায়ী এ প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী ক্ষমতা প্রশাসনের হাতে ন্যস্ত। তবে দীর্ঘদিন ধরে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দিয়ে প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনায় যোগ্যরা বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্টের ১২ এর ৬ ধারা অনুযায়ী, উপাচার্য প্রয়োজনে উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ বাদে সব পদে অনধিক ছয় মাসের জন্য ভারপ্রাপ্ত হিসেবে প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ দিতে পারেন। তবে ছয় মাসের অধিক ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হলেও প্রশাসন নিরব।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ২০টি প্রশাসনিক পদে ভারপ্রাপ্ত প্রধান দিয়েই কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এর মধ্যে ১৮টি পদে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্তদের মেয়াদ (ছয় মাস) অনেক আগে পার হলেও স্বপদে বহাল রয়েছেন তারা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারকে প্রশাসনিক কার্যক্রমের প্রাণ বলা হলেও জাবির রেজিস্ট্রার কার্যালয় গত চার বছর ধরে ভারপ্রাপ্ত প্রধান দিয়ে চলেছে। সর্বশেষ এ মাসে সাবেক ভারপ্রাপ্ত রেজিস্টার রহিমা কানিজকে এক বছরের চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবে গত বছরের ৩০ অক্টোবর চাকরির মেয়াদ শেষ হলেও সেশন বেনিফিটের কারণ দেখিয়ে এ বছরের ২৯ জুন পর্যন্ত নিজ কর্মস্থলে কাজ করেছেন তিনি।
এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও আ ফ ম কামালউদ্দিন হলের প্রভোস্ট আ স ম ফিরোজ উল হাসান, কম্পট্রোলার মো. মোসানুল কবীর, সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক আকবার হোসেন, বিজনেস স্টাডিজ অনুষদের ডিন নীলাঞ্জন সাহা, আইন অনুষদের ডিন তাপস কুমার দাস, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মুহম্মদ নজরুল ইসলাম, আল বেরুনি হলের প্রভোস্ট মো. আশরাফুল আলম, প্রকৌশল অফিসের প্রধান আবদুস সালাম মো. শরীফ, চিকিৎসা কেন্দ্রের প্রধান মেডিকেল অফিসার ডা. মো. শামছুর রহমান, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন অফিসের পরিচালক প্রকৌশলী নাসির উদ্দিন, জনসংযোগ অফিসের পরিচালক ড. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, শারীরিক শিক্ষা অফিসের পরিচালক বেগম নাছরীন, পরিবহন অফিসের শিক্ষক অধ্যাপক মুহাম্মদ ছায়েদুর রহমান, গ্রন্থাগার শিক্ষক অধ্যাপক এম শামীম কায়সার, বিজ্ঞান কারখানার শিক্ষক অধ্যাপক মো. সালাহউদ্দিন, আইসিটি সেলের শিক্ষক অধ্যাপক মোহাম্মদ শরীফ উদ্দিন ও অতিরিক্ত শিক্ষক অধ্যাপক মো. গোলাম মোয়াজ্জাম ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
এ ব্যাপারে দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন বলেন, 'আমরা এ বিষয় নিয়ে আগেও কথা বলেছি যে এতগুলো ভারপ্রাপ্ত দিয়ে এতদিন কীভাবে চলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। প্রশাসন এতগুলো ভারপ্রাপ্ত রাখেন যাতে ওই পদে যারা থাকেন তারা প্রশাসনের অধীনস্ত হয়েই থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এটা অবশ্যই ভাল নয়। বিশ্ববিদ্যালয় ঠিকঠাক চলার জন্য এতগুলো ভারপ্রাপ্ত রাখার কোনো মানে নেই। এখন সব ক্ষেত্রেই এরকম চলছে। মানে কোনো প্রশাসনই দায়িত্ব কাজগুলো করে না। দায়িত্ব নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালোর জন্য বা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য এ রকম পদক্ষেপ নিতে চান না। এটা খুবই দুঃখজনক। যেমন আগের প্রশাসন তাড়াহুড়ো করে কোনো মাস্টারপ্ল্যান ছাড়া, নগর পরিকল্পনাবিদদের অংশগ্রহণ ছাড়া যেখানে সেখানে ভবন নির্মাণ করে গেছেন। বর্তমান প্রশাসন আগের প্রশাসনের মতই তাড়াহুড়ো করে নিজের পছন্দমত জায়গায় গাছপালা কেটে ভবন নির্মাণ করছেন।'
ভারপ্রাপ্ত শিক্ষকরা তাদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও চুপ থাকেন এটা কি তাদের নৈতিকতার সঙ্গে যায়? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'এটা তো কোনো দিক দিয়ে কাম্য নয়। হোক সেটা আইনগত দিক বা নৈতিকতার দিক। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য এ রকম নিয়োগ দিয়ে থাকেন। যেন তারা তাদের অধীনস্ত থাকে, তাদের পকেটে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্ত হয়ে থেকে কাজ করার জন্য ভারপ্রাপ্ত কিছু বলেন না বলে আমার মনে হয়।'
তিনি বলেন, 'সব বিষয় নিয়ে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করবে এটা তো কাম্য নয়। কিন্তু এটা হচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে সব বিষয় নিয়েই শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করতে হচ্ছে।'
এ ব্যাপারে ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদের সভাপতি রাকিবুল রনি বলেন, 'উপাচার্য কোনো পদে ভারপ্রাপ্ত কাউকে বসালেও তা অনধিক ৬ মাসের জন্য হওয়ার কথা। অথচ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ভারপ্রাপ্ত দিয়ে চলছে। এতে দুইটা ঘটনা ঘটে। এক প্রশাসনিক স্থবিরতা, যার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আর অন্যটি হলো পদ কিংবা ক্ষমতার বিনিময়ে উপাচার্যের প্রতি সীমাহীন আনুগত্য। বর্তমান উপাচার্যও সাময়িক সময়ের জন্য নিয়োগ পেয়েছেন।'
তিনি বলেন, 'উপাচার্য, ডিন, সিনেট, সিন্ডিকেট সকল পর্ষদের নির্বাচনের চর্চা অব্যাহত থাকলে স্থবিরতা, স্বেচ্ছাচারিতার পরিবর্তে কিছুটা হলেও গণতান্ত্রিকতা এবং নিষ্ঠার চর্চা আমরা দেখতে পেতাম। সেসব চর্চা তো নেই, উল্টো পুরো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিভিন্ন স্থর ভারপ্রাপ্তের ভারে ধুঁকছে দীর্ঘদিন ধরে।'
এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. নূরুল আলমকে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
এদিকে গত ২ মার্চ সাবেক উপাচার্যের দায়িত্বের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মো. নূরুল আলমকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক অফিস আদেশে উপাচার্যের রুটিন দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ১৭ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে নূরুল আলমকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাময়িক উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
এসজি/