উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় অর্থের যোগান বড় চ্যালেঞ্জ
কয়েক বছরে বাংলাদেশে ধারাবাহিক উন্নয়ন হয়েছে। আমরা এলডিসি থেকে উত্তরণ করেছি। এর ফলে আমাদের প্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষা বেড়েছে। এর আলোকে আমি যদি ২০২৩-২৪ এর বাজেটের কথা চিন্তা করি, তাহলে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আমরা বলছি, আমাদের বাজেটের আকার বড় হয়েছে। কিন্তু জিডিপির মাত্রায় যদি আমরা দেখি, এটি কিন্তু এখনো ৫-৬ শতাংশ। অর্থাৎ এটা ১৪-১৫ শতাংশের বেশি না। দক্ষিণ এশিয়ায় সরকারের যেই ব্যয়, সে অনুযায়ী জিডিপির অংশ হিসেবে আমাদের এটা সবচেয়ে কম। সুতরাং প্রথম যেই সমস্যাটা আমাদের বাজেট প্রণেতাদের মুখোমুখি হতে হয় সেটা হলো আমাদের আরও অর্থের প্রয়োজন। অর্থের সংকুলান করাটাই এখন একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
আসন্ন অর্থবছরের বাজেটে অর্থের সংকুলান করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। বাজেটের তিনটি দিকের মধ্যে একটি হলো সম্পদ আহরণ, দ্বিতীয়টি সম্পদের বণ্টন এবং তৃতীয়টি হলো সম্পদ বণ্টনের দক্ষতা। সম্পদ আহরণের দিক থেকে যদি বলি, যে চ্যালেঞ্জের প্রেক্ষিতে বাজেটটি প্রণয়ন করা হয়েছে— আমাদের একটি মূল্যস্ফীতির চাপ আছে, কোভিড থেকে আমাদের অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর প্রয়োজনীয়তা আছে। সাধারণ মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রেক্ষিতে তাদের জীবন মানের নিশ্চয়তা বিধানের একটি প্রয়োজনীয়তা আছে। এটির প্রেক্ষিতে যদি দেখা যায়, তাহলে আমি বলব সেখানে কিছু কিছু প্রচেষ্টা আছে, যাতে করে বিনিয়োগকে প্রণোদিত করা যায়। সাধারণ মানুষের মূল্যস্ফীতির চাপকে সহনীয় করা যায়। তারপরও আমার মনে হয় যে, কিছু কিছু জায়গায় বাজেটে দুর্বলতা রয়ে গেছে।
সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে আমাদের আরও উচিত হবে আরও বেশি প্রচেষ্টা গ্রহণ। আমাদের দেশে এখনো অপ্রত্যক্ষ করের উপরেই রয়ে গেছে। কাজেই প্রত্যক্ষ কর আহরণের দিকে আমাদের আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত। স্থানীয় শিল্পকে সংরক্ষণ দেওয়ার একটি প্রচেষ্টা আছে আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে এবং উৎপাদনের উপর শুল্ক কমিয়ে। আমার মনে হয় যারা নিম্নবিত্ত আছে তাদের স্বস্তি দেওয়ার জন্য করের আয় সীমা না বাড়লেও নিম্নতম করের উপর যে এক লাখ টাকার ৫ শতাংশ এর যে একটি স্ল্যাব আছে সেটিকে আরও বাড়িয়ে এটি করা যেতে পারত। তাহলে যারা স্বল্প আয়ের মানুষ তাদের কর কিছুটা কম দিতে হতো। সর্বোচ্চ যে কর যেটি ৩০ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশ এ নামানো হয়েছিল, কোভিডের সময়ে উচ্চ আয়ের মানুষদের তেমন একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। আর বিতরণের দিক থেকে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাতগুলো ঠিকই ছিল। কিন্তু আমরা দেখেছি যে সামাজিক সুরক্ষাখাতে যদিও বরাদ্দ কিছুটা টাকার অংকে বেড়েছে, আমরা যেটি দেখি পেনশন, বেতন, সঞ্চয়পত্রে সরকারের ভর্তুকি, এটিকে বাদ দিলে সামাজিক সুরক্ষায় প্রকৃত ব্যয় তিন হাজার কোটি টাকা কমে গেছে।
শিক্ষাখাতে শিশুদের দুই বছরের ব্যত্যয় হয়েছে, শিক্ষালাভের ক্ষেত্রে, সেখানে শিক্ষাখাতে বরাদ্দটুকু আরও বৃদ্ধি করা দরকার বলে আমি মনে করি। বিশেষত ২০১৮ সালের বাজেটে বলা হয়েছিল চাইল্ড বাজেট আলাদা করে দেওয়া হবে ১৫.৫ শতাংশ পুরো বাজেটের এবার সে বিষয়েও কিছু বলা হয়নি। আমার মনে হয় যে, শিশু ও মাতৃত্বকালীন প্রকল্প অর্থাৎ সব মা ও শিশুকে এর আওতায় নিয়ে আসা, সেক্ষেত্রেও বরাদ্দ বৃদ্ধি করা দরকার বলে আমার মনে হয়েছে।
সামগ্রিকভাবে আমাদের দেশে সরকারি ব্যয় জিডিপির ১৫.৫ শতাংশ এর মতো। এটি কিন্তু দক্ষিণ এশিয়াতে সর্বনিম্ন। আমাদের সেটি বাড়াতে হবে এবং সেটি করতে হলে আমাদেরও সম্পদ আহরণ বাড়াতে হবে। এসব জায়গাগুলোতে আরও বিনিয়োগ করা দরকার। কর প্রস্তাবে যেটি বলা হয়েছে যে, বাইরের টাকা দেশে আনার জন্য প্রণোদনা দেওয়া, বাইরের টাকা ১৫ শতাংশ দেখিয়ে সেটিকে লিগ্যালাইজ করা, সেটিকে দেশে নিয়ে আসতে গেলে ১০ শতাংশ অথবা টাকার ক্ষেত্রে ৭ শতাংশ ইত্যাদি যেসব সুযোগ দেওয়া হয়েছে সেটি আমি মনে করি, নৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য, অর্থনৈতিকভাবে অযৌক্তিক এবং রাজনৈতিকভাবেও এটি সমর্থনযোগ্য নয়।
অর্থনৈতিকভাবে কতটুকু কী হবে জানি না, তবে ন্যায়ের শাসনে ব্যত্যয় হবে বলে মনে করি। সুতরাং কীভাবে দেশ থেকে অর্থপাচার না হয়, সেদিকে খেয়াল করে, যে আইন কানুনগুলো আছে সেগুলো যদি কাজে লাগানো যায়, অর্থনৈতিকভাবে শূন্যসহিষ্ণুতা বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী যে কথাটি সবসময় বলেন, সেদিকে আমাদের নজর দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান: অধ্যাপক ও সম্মানীয় ফেলো, সিপিডি
আরএ/