‘মে দিবস’ শ্রমিক আন্দোলনের প্রেরণা
৮ ঘণ্টা কাজ, ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম আর ৮ ঘণ্টা জীবন বিকাশের জন্য বিনোদন চাই। দাবিটা ছিল স্পষ্ট আর লড়াই ছিল সরাসরি। লড়াই করেছিল শ্রমিকরা কিন্তু দাবিটা ছিল সকল মানুষের। মানুষের প্রয়োজন মেটানোর জন্য কাজ যেমন দরকারি, জীবনের ও সমাজের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের জন্য অবসরটাও তেমনি প্রয়োজন। বিশ্রাম বা অবসরের দাবিসহ ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবিতেই গড়ে উঠেছিল মে দিবসের রক্তাক্ত সংগ্রাম তার ১৩৭ বছর পালন করছে শ্রমিক শ্রেণি।
আন্দোলন ছাড়া অধিকার প্রতিষ্ঠা হয় না আর অধিকার ছাড়া মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয় না। এ কথা শ্রমিকরা জীবন ও অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝেছে বারবার। এখনো দেখছে কি এক যন্ত্রণাময় জটিলতায় পড়েছে সারা পৃথিবী। একদিকে উন্নয়ন তুঙ্গে উঠছে অন্যদিকে শ্রমিকের জীবনের অনিশ্চয়তা তীব্র হচ্ছে। একদিকে কাজ না পাওয়া অন্যদিকে কাজ পেলেও ৮ ঘণ্টা কাজ করে মানসম্মত জীবনযাপন করা যাবে এমন মজুরি কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না।
মে দিবসের ইতিহাস এক গতিময় সংগ্রামের ইতিহাস। ফরাসি বিপ্লব ভেঙেছিল দীর্ঘদিনের সামন্তবাদি সমাজের স্থবিরতা। সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার স্লোগান তুলে মানুষের চিন্তাকে উন্নত মানবিক স্তরে উন্নত করেছিল। কিন্তু জনগণের মনে গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা থাকলেও পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় শ্রম শোষণের তীব্রতা তো কমলোই না বরং বহুগুণ বেড়ে গেল। শিল্প বিপ্লব উৎপাদন বৃদ্ধির নতুন নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছে, গ্রাম থেকে লক্ষ লক্ষ কৃষক শিল্প কারখানায় এসেছে, সৃষ্টি হয়েছে বিপুল সংখ্যক শ্রমজীবী মানুষের। একদিকে বেড়েছে উৎপাদন অন্যদিকে বেড়েছে শ্রমিকদের উপর কাজের চাপ। একের পর এক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, নতুন যন্ত্রপাতির ব্যবহার উৎপাদনের বহুমুখী বিকাশ ঘটিয়েছে। ফলে সমাজের সমৃদ্ধি, ধনীদের বিলাসিতা বৃদ্ধি পেয়েছে পাশাপাশি শ্রমিকদের কর্ম ঘণ্টা বেড়েছে, বেড়েছে দারিদ্র্য। জীবনের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটাতে ১৬/ ১৮ ঘণ্টা কাজ করা শুধু নয়, নারী ও শিশুদের কারখানায় পাঠাতে বাধ্য হতে লাগলো শ্রমজীবী মানুষরা। মালিকরা মুনাফা বাড়াতে শ্রম ঘণ্টা বাড়ানোর জন্য শ্রমিকদের উপর যে চাপ প্রয়োগ করতো তা শ্রমিকদের জীবন একেবারে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা সর্বত্রই তাই কর্ম ঘণ্টা কমানোর দাবি জোরদার হয়ে উঠছিল। ১৮৩২, ১৮৩৯, ১৮৪৮, ১৮৫৭, ১৮৭৫ সালে বড় বড় শ্রমিক আন্দোলনে শ্রমিকরা তাদের দাবিতে যেমন রাজপথে নেমে এসেছিল, মালিকরাও তাদের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে সে সব আন্দোলনকে দমন করেছে। ১৮৮৬ সালে ৮ ঘণ্টা কর্ম দিবসের দাবি তাই কোনো তাৎক্ষণিক দাবিতে গড়ে উঠা আকস্মিক আন্দোলন ছিল না। এটা ছিল দীর্ঘদিনের বঞ্চনা থেকে মুক্তির আশায় শ্রমিক শ্রেণির লড়াইয়ের অংশ। ৮ ঘণ্টা কর্ম সময়ের দাবিতে ১৮৮৬ সালের ১ মে ও ৪ মে আন্দোলন এবং শ্রমিক নেতাদের ফাঁসির ঘটনায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। ভয় না পেয়ে শ্রমিকরা আরও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠে। ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই ইন্টারন্যাশনাল সোশালিস্ট কংগ্রেস ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালনের ঘোষণা দেয়। ১৯১৯ সালে আইএল ও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ৮ ঘণ্টা কর্ম দিবস ও ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস ঘোষণা করা হয়।
শ্রমিক এবং শ্রমশক্তির গুরুত্ব কি তা সমাজের চারদিকে তাকালেই বুঝতে অসুবিধা হয় না। প্রকৃতিতে যা আছে তা দিয়ে অন্য প্রাণীর চললেও মানুষের চলে না । তাই সে প্রকৃতিতে প্রাপ্ত বস্তুর উপর শ্রম প্রয়োগ করেই তার প্রয়োজনীয় দ্রব্য উৎপাদন করে । শ্রমশক্তি প্রয়োগ করা থেকেই শ্রমিক নামের উৎপত্তি। শ্রমিক কাজ করে একই সঙ্গে নিজের ও সমাজের জন্য। মানুষ যা খায়, যা পরে, তার বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা এমনকি মানুষের ভাষাও শ্রমের মাধ্যমে এবং শ্রমের প্রয়োজনে সৃষ্ট। শ্রমের ফলে মানুষ শুধু নিজের প্রয়োজন মেটায় না, উদ্বৃত্ত সৃষ্টি করে । এই উদ্বৃত্ত আত্মসাৎ করার ফলেই একদল সম্পদশালী হয় আর বাকিরা নিঃস্ব হয়। অর্থনীতিবিদরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন কেন এই ঘটনা ঘটে? উইলিয়াম পেটি, অ্যাডাম স্মিথ, রিকারডো দেখিয়েছেন শ্রমের ফলে মুল্য তৈরি হয় পরবর্তীতে কার্ল মাক্স দেখালেন কীভাবে উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরি হয়। ১৮৪৮ সালে মার্ক্স- এঙ্গেলস কম্যুনিস্ট মেনিফেসটো আর পরবর্তীতে মার্ক্স ক্যাপিটাল লিখে দেখালেন এ যাবত কালের লিখিত ইতিহাস একদিকে যেমন শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস অন্যদিকে মানুষের বিকাশের ইতিহাস। কিন্তু জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ, শিক্ষা সংস্কৃতির বিকাশ যা ঘটেছে শ্রমের ফলে তা থেকে কি বঞ্চিত হবে শ্রমজীবী মানুষ? জীবিকার জন্য দিনের ১২/১৪/১৬ ঘণ্টা যদি হাড় ভাঙা পরিশ্রম করতে হয় তাহলে শ্রমজীবী মানুষ কিভাবে তাদের জ্ঞান ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাবে। আর বিপুল সংখ্যক মানুষকে বঞ্চিত রেখে সমাজের সুষম বিকাশ কি সম্ভব হবে? যন্ত্রের বিকাশ কি মানুষের শ্রম সময় লাঘব করবে না? কতক্ষণ কাজ করলে একজন মানুষ তার জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করতে পারে? এ সব প্রশ্নের উত্তর পেতে গিয়ে শ্রমজীবী মানুষের দাবি উচ্চারিত হয়েছিল ৮ ঘণ্টা কাজ, এটাই হবে কর্ম সময়। কিন্তু মজুরি যদি ন্যায্য না হয় তাহলে জীবন-যাপনের জন্য শ্রমিকদের অতিরিক্ত সময় কাজ করতে বাধ্য হতেই হবে। শ্রমিক শ্রেণি এটাও দেখছে যে যত গণতন্ত্রের কথা বলা হোক না কেন শোষণমূলক ব্যবস্থা বহাল রেখে ৮ ঘণ্টা কর্ম সময় এবং ন্যায্য মজুরি আদায় করা সম্ভব নয়।
শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রম শোষণ যে বন্ধ হয় না বরং নতুন নতুন পদ্ধতিতে শ্রমিককে শোষণ করতে থাকে তা বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় বাজার সংকট, বাজার দখল করতে বিশ্বযুদ্ধ ও আঞ্চলিক যুদ্ধ, আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ানো সবই তো বিশ্ববাসী দেখছে। ফলাফল হিসেবে মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে বিপুল সম্পদের পাহাড় জমছে। ৮ জন অতি ধনীর হাতে বিশ্বের অর্ধেক মানুষের সম্পদের সমান সম্পদ দেখলে বুঝতে অসুবিধা হয় না শোষণ কত আন্তর্জাতিক রূপ নিয়েছে। আফ্রিকার কয়লা, লোহা, মধ্যপ্রাচ্যের তেল, ল্যাতিন আমেরিকার কফি আর এশিয়ার শ্রমিক সবই তো শোষণ লুণ্ঠনের জালে আবদ্ধ। করোনা মহামারির সংক্রমণ আর চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের নামে রোবট নির্ভর শিল্প, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার সবই বৈষম্যকে প্রকট করে তুলছে। অল্প শ্রমিক দিয়ে অধিক উৎপাদনের নতুন নতুন পদ্ধতি শুধু বেকারত্ব বাড়াচ্ছে না, ক্রয় ক্ষমতাও কমিয়ে দিচ্ছে। বিপুল বিনিয়োগ, তীব্র বেকারত্ব, যাদের কাজ আছে তাদের দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, বিশাল বৈষম্য আজ বিশ্বকে ভাবিয়ে তুলছে। এর মধ্যে আবার যুক্ত হয়েছে যুদ্ধের দামামা।
বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়। ৭ কোটি ৩৪ লাখ শ্রমজীবীদের দেশ। করোনা মহামারির পর বিপুল সংখ্যক শ্রমিক কাজ হারিয়েছে। এখন আবার যুদ্ধের বলি হচ্ছে শ্রমজীবী মানুষ, দ্রব্যমুল্যের কষাঘাতে জর্জরিত হচ্ছে শ্রমজীবীরাই। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের নামে যে নতুন শ্রম পরিস্থিতির উদ্ভব হচ্ছে তাতে উৎপাদন বাড়বে বিপুল কিন্তু এর ফলে বেকারত্বের সংখ্যাও বাড়বে পাল্লা দিয়ে। আউট সোরসিং এর নামে চাকুরির নিরাপত্তা এবং স্থায়িত্ব হারাচ্ছে শ্রমজীবীরা এবং প্লাটফর্ম ইকনমি ও গিগ ইকনমি নামক নতুন ধরনের কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে। যার প্রভাব পড়ছে কর্মক্ষেত্রে আর শ্রমিকদের জীবনে নেমে আসছে অনিশ্চয়তা। অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজের ধরন ও শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে, ফলে দেশের ৪৩ সেক্টরের মজুরি বোর্ড দিয়ে সকল শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণ করা যাচ্ছে না। নতুন নতুন যে সব কর্মক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে শ্রম আইন ও বিধি দ্বারা সেসব খাতের শ্রমিকদের সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। মে দিবসের চেতনায় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, গিগ ইকনমি, প্লাটফর্ম ইকনমির যুগে শ্রমিকের কাজের নিশ্চয়তা, নিরাপত্তা, কর্ম সময় আর ন্যায্য মজুরির আন্দোলন গড়ে তোলা আরও অনেক বেশি প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে।
রাজেকুজ্জামান রতন: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)
আরএ/