মূল্যস্ফীতি সামাল দেওয়াই মানুষের বড় চ্যালেঞ্জ
সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় স্বস্তিদায়ক অবস্থান থেকে বের হয়ে গেছে বাংলাদেশ। সামষ্টিক অর্থনীতি কিছুটা হলেও ঝুঁকিতে পড়েছে। টাকার অবমূল্যায়ন, সরকারের কৃচ্ছ্রসাধন, আমদানি নিরুৎসাহিত করা-এসব উদ্যোগ অর্থনীতির ঝুঁকির বার্তা দেয়। সাধারণত একটি অর্থনীতির সক্ষমতার সূচকগুলো দুর্বল হলে ধীরে ধীরে ঝুঁকিতে পড়ে যায়। শুধু বাংলাদেশ নয়; বৈশ্বিক বর্তমান পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি ঝুঁকিতে আছে। তবে এটা সাময়িক। সঠিকভাবে সামাল দিতে হবে যেন এই ঝুঁকি গভীর না হয়। গভীর হলে অর্থনৈতিক সংকট দীর্ঘায়িত হবে, যা সার্বিকভাবে উন্নয়ন ব্যাহত করবে।
অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবিলার পাশাপাশি মধ্যমেয়াদি সংস্কার পদক্ষেপও নিতে হবে। এসব সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার কথা যেন ভুলে না যাই। বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার বাড়ছে। কিন্তু কর-জিডিপির অনুপাতে বাংলাদেশ খুবই নিচের দিকের একটি দেশ। আবার এ দেশে প্রকল্প যথাসময়ে শেষ করা যায় না। এতে খরচ বাড়ে। ফলে প্রকল্পের সুবিধা নেওয়া যাচ্ছে না, যা সার্বিকভাবে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তাই উন্নয়ন প্রকল্প সাশ্রয়ীভাবে সুশাসনের সঙ্গে বাস্তবায়ন করার তাগিদ থাকতে হবে। অন্যদিকে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, কিন্তু সম্পদ ও আয়ের বৈষম্য বাড়ছে। ধনী-গরিবের মধ্যে ব্যবধান আরও বাড়ছে। এতে অভ্যন্তরীণ চাহিদায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এই মুহূর্তে সরকারের উচিত, অপেক্ষাকৃত অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প (যা এই মুহূর্তে বাস্তবায়ন না করলে তেমন ক্ষতি হবে না) বাস্তবায়ন শ্লথ করা। তবে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন মাঝামাঝি বা শেষের দিকে আছে, তা অব্যাহত রেখে দ্রুত শেষ করা উচিত। কারণ, ওই সব প্রকল্প পিছিয়ে পরবর্তীকালে আবার বাস্তবায়ন করতে গেলে খরচ আরও বাড়বে। তাই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তালিকা করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা উচিত।
সার্বিকভাবে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এখন চ্যালেঞ্জের মুখে আছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারের নানা উদ্যোগের কারণে অর্থনীতি বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি যদি শ্লথও হয়, তা উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে মেনে নেওয়া উচিত।
শাসনের সঙ্গে সুশাসন নতুন বছরের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সামগ্রিকভাবে সুশাসন বাড়ানোই হচ্ছে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, এ বছর কিছুটা রাজনৈতিক চাঞ্চল্য থাকবে। তবে তা যেন অর্থনীতির উপরে চাপ সৃষ্টি না করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এজন্য সমঝোতাপূর্ণ রাজনীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে এ বছর। মূল্যস্ফীতি সামাল দিয়ে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বজায় রাখাও চ্যালেঞ্জ। এটা করতে হলে বিনিয়োগকে চাঙা করে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির ব্যাপ্তি-প্রাপ্তি বাড়াতে হবে। রিজার্ভের উপরে যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে, তা কিছুটা কমবে বলে মনে হয়। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য কমতে শুরু করেছে। তবে অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারের এ সুফল সাধারণ মানুষকে দিতে হবে। এজন্য আর্থিক নীতি এবং রাজস্ব নীতি সমন্বয় করে মানুষের উপরে যে চাপ তা কমাতে হবে।
আমদানি কমানোর কারণে এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কিন্তু বৈদেশিক বিনিময়ে যে ভারসাম্য সেটা কিছুটা উন্নতি করবে বলে মনে হচ্ছে। আগামী বছরে কিছুটা নিচে পর্যায়ের ভারসাম্যের দিকেই থাকতে হবে বলে মনে হয়। কারণ আমদানি, মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনীতিতে যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে তাতে মনে হচ্ছে অর্থনীতি নতুন একটি ভারসাম্যে আসবে, ঝুঁকিও হয়তো কিছুটা কমবে। কিন্তু প্রবৃদ্ধির উপরে এর একটি বড় প্রভাব পড়বে।
মূল্যস্ফীতি ব্যবস্থাপনা করা, আমদানি পর্যায় থেকে ভোক্তা পর্যায়ে এবং উৎপাদক পর্যায় থেকে ভোক্তা পর্যায়ে বাজার ব্যবস্থাপনা উন্নত করা, সামাজিক সুরক্ষা শক্তিশালী করা, সব বিষয়ে সুশাসন জোরদার করার পাশাপাশি অর্থনৈতিক সংস্কারের ক্ষেত্রে আরও নজর দিতে হবে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, মুদ্রা ব্যবস্থাপনা, সংস্কার কর্মসূচি ও সামাজিক সুরক্ষা শক্তিশালী করতে হবে। সেই সঙ্গে সুশাসনের জায়গাগুলোতে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান: অধ্যাপক ও সম্মানীয় ফেলো, সিপিডি