অগ্নিদুর্ঘটনা এড়াতে নির্মাণ থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি
বাংলাদেশে বেশিরভাগ ভবন, বিপণিবিতান ও বাসাবাড়িতে অগ্নি নিরাপত্তার বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়া হয় না এবং এ কারণেই এ ধরনের দুর্ঘটনার সময় ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা যায় না। যেকোনো অগ্নিদুর্ঘটনা ঠেকাতে বা এর ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে হলে ভবন নির্মাণ পর্যায় থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে।
আগুন লাগলে সেটি ছড়িয়ে পড়া অনেকাংশেই ঠেকানো সম্ভব যদি আগে থেকেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যায়। ভবনের অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে দুটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। একটি হলো অ্যাকটিভ সিস্টেম বা সক্রিয় ব্যবস্থা এবং অন্যটি প্যাসিভ সিস্টেম বা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। অগ্নি নিরাপত্তায় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাটাই সবচেয়ে জরুরি। এটা বাড়ি নির্মাণের সময় মূল নকশার সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে হবে এবং সিভিল ইঞ্জিনিয়ারকে তা নিশ্চিত করতে হবে। আর সক্রিয় ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে আগুন ধরে গেলে সেটির ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে। আগুন নেভাতে প্রশিক্ষিত জনবল নিয়োগ করা যেতে পারে আধুনিক বহুতল ভবনগুলোতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, হিটিং, বিদ্যুৎ এবং গ্যাস সংযোগের জন্য যে পাইপগুলো টানা হয়, সেগুলো যায় ডাক্ট লাইন এবং ক্যাবল হোলের ভেতর দিয়ে। এই ডাক্ট লাইন ও গর্ত দিয়ে ধোঁয়া এবং আগুন খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। এজন্যে ডাক্ট লাইন ও ক্যাবল হোলগুলো আগুন প্রতিরোধক উপাদান দিয়ে ভাল করে বন্ধ করে দিতে হবে।
এ ছাড়া, ভবনের অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জার জন্য ব্যবহৃত কোনো কিছুর মাধ্যমেও যাতে আগুন ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
নির্মাণের সময় কী ধরনের উপাদান ব্যবহার করা হচ্ছে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভূমিকম্প এবং আগুন লাগার মতো দুর্ঘটনা ঠেকাতে এ ধরনের উপাদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এক্ষেত্রে দরজা এবং দেয়াল আগুন প্রতিরোধী হলে ভালো হয়। এ ছাড়া, ঘরের সিলিং, রান্নাঘরের আসবাবপত্র আগুন প্রতিরোধী পদার্থে নির্মাণ এবং আগুন প্রতিরোধী তার ব্যবহার করলে আগুন লাগলেও সেটি ছড়িয়ে পড়ার ভয় থাকে না। সিনথেটিক বা হাইড্রোকার্বন উপাদান থাকে এমন কোনো পদার্থ দিয়ে ভবনের ভেতরের সাজসজ্জা না করাই ভাল। এসব উপাদানের মাধ্যমে একদিকে যেমন আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে অন্যদিকে তেমনি আগুন লাগলে এসব উপাদান পুড়ে বিষাক্ত ধোয়া তৈরি হয় যা নিঃশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করলে মানুষ প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। ফলে আগুনে প্রাণহানির সংখ্যা বাড়ে। আবার এসব ধোঁয়ার কারণেই অনেক সময় মানুষ মারা যায়।
প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেওয়ার পরও যদি আগুন লাগে তাহলে সেক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতিয়ে কমিয়ে আনার একটা উপায় হচ্ছে ফায়ার এবং স্মোক অ্যালার্ম সিস্টেম বসানো এবং সেটি ঠিক মতো কাজ করে কি না তা নিয়মিত পরীক্ষা করা। অ্যালার্ম সিস্টেম কাজ করলে কোনো এক জায়গায় আগুন লাগলে সবাই আগুন সম্পর্কে জানতে পারে এবং দ্রুত তারা জায়গা খালি করে নিচে নেমে আসতে পারে। ফলে প্রাণহানি ব্যাপকভাবে কমানো সম্ভব। যেকোনো ভবনেই আগুন লাগলে সেটি থেকে বের হয়ে আসার জন্য বাইরে একটা জরুরি বহির্গমন পথ থাকতে হবে। এটা হতে হবে এমন একটি পথ যেখানে আগুন এবং ধোঁয়া প্রবেশ করতে পারবে না। কারণ, কোনো ভবনে আগুন লাগলে বা ভূমিকম্প হলে ওই ভবনের লিফট ব্যবহার না করার পরামর্শ দেওয়া হয়। প্রতিটি ভবনেই অগ্নি নির্বাপণ সিলিন্ডার বা ফায়ার এক্সটিংগুইশার থাকাটা নিশ্চিত করতে হবে। সেইসঙ্গে এগুলো ব্যবহার করতে জানতে হবে
আগুন লাগার পর সেটি ছড়িয়ে পড়তে কিছুটা হলেও সময় লাগে। এই সময়ের মধ্যে যদি অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা দিয়ে সেটি নিভিয়ে ফেলা যায় তাহলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। আগুন লাগার পর প্রথম দুই মিনিটকে বলা হয় প্লাটিনাম আওয়ার বা সবচেয়ে মূল্যবান সময়। এই সময়ে ঘাবড়ে না গিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় ব্যবস্থা নিয়ে ক্ষয়ক্ষতি অনেক কমানো যায় বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের সাবেক পরিচালক মি. নওয়াজ। আগুন নেভানোর জন্য একটা প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা হচ্ছে স্প্রিঙ্কলার সিস্টেম। এটি কোনো একটি ভবনের পানি সরবরাহ ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত থাকে। এই ব্যবস্থায় কোনো একটি স্থানে তাপমাত্রা ৫৭ ডিগ্রির বেশি হলে এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিস্ফোরিত হয়ে পানি ছিটিয়ে পড়তে থাকে। ফলে আগুন নিভে যায়। বড় বড় বাণিজ্যিক বা কারখানা ভবনে সাধারণত এগুলো ব্যবহার করা হলেও বর্তমানে আবাসিক ভবনগুলোতেও এগুলোর ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। প্রাথমিকভাবে সবাইকেই জানতে হবে যে, ফায়ার এক্সটিংগুইশার কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, আগুন লাগলে কীভাবে ফায়ার সার্ভিসকে ডাকতে হবে। আগুন লাগলে সেখান থেকে কীভাবে বের হয়ে আসতে হবে তার জন্য নিয়মিত মহড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সবার অংশগ্রহণে মাসে অন্তত এক বার এ ধরনের মহড়া করা উচিত। আগুন লাগলে কার কী দায়িত্ব তা আগে থেকেই ভাগ করে দিতে হবে। আগুন থেকে উৎপন্ন ধোঁয়া যাতে কেউ নিঃশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ না করে, ভবন থেকে নামতে যাতে সিঁড়ি ব্যবহার করে, ভেজা তোয়ালে দিয়ে মুখ ঢেকে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে হবে-এ বিষয়গুলো অবশ্যই জানতে হবে।
এ ছাড়া, কোনো অবস্থাতেই উদ্বিগ্ন না হওয়া বা ঘাবড়ে গিয়ে ভবন থেকে লাফিয়ে পড়া থেকে বিরত থাকতে হবে। বহুতল ভবনগুলোতে অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম এমন দক্ষ জনবল নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। যাতে করে আগুন লাগলে তারা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে পারে।
ইকবাল হাবীব: নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি