নতুন বছরে নতুন চ্যালেঞ্জ
টানটান উত্তেজনাপূর্ণ একটি বছর পার করল বিশ্ব। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে গেল বছর বেশ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও ছড়িয়েছিল। নতুন বছর কেমন যাবে তা হয়তো জ্যোতির্বিদরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে বিশ্ব খাদ্য সংস্থা আগাম সতর্ক বার্তা দিয়েছে।
সংস্থাটি বলেছে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়তে পারে। খাদ্য সংকট যে ভয়াবহ রূপ নেবে সে কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। কারণ, খাদ্য উৎপাদনকারী দুটি বড় দেশ রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। যুদ্ধ এখনো চলছে। করোনা অতিমারির কারণে সারাবিশ্ব যখন অর্থনৈতিক সংকটে হিমশিম খাচ্ছিল ঠিক সেই মুহূর্তে বিশ্বের উপর একটি যুদ্ধ চাপিয়ে দিল রাশিয়া। এ যেন গোদের উপর বিষফোঁড়া।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নানামুখি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। সারা বিশ্বে খাদ্য ও জ্বালানি সংকট ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। আমদানি-রপ্তানি খাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বৈদেশিক বিনিয়োগ, কর্মসংস্থানের বড় ধরনের আঘাত এসেছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অনুন্নত-উন্নয়নশীল দেশই নয়, উন্নত দেশগুলোকেও আগামী বছরের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার বিষয় নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোগাবে খাদ্য সংকট ইস্যুটি।
বিশ্বের অন্যতম প্রধান খাদ্যশস্য উৎপাদনকারী দেশ ইউক্রেন রাশিয়া গেল বছর খাদ্য উৎপাদন করতে পারেনি। বাংলাদেশ ইউক্রেন থেকে বিপুল পরিমাণ গম আমদানি করত। রাশিয়া থেকেও আমদানি করা হতো। চাল আমদানি করে ভারত, ভিয়েতনাম থেকে। এ বছর উৎপাদন কম হওয়ায় এসব দেশ থেকে আমদানি করা সম্ভব হচ্ছে না। থাইল্যান্ড ও মিয়ানমার থেকে কী পরিমাণ চাল আমদানি করতে পারবে তার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করছে। আবার বিকল্প বাজারও খোঁজা হচ্ছে।
নতুন বছরের শুরু থেকে বাংলাদেশকে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এরমধ্যে খাদ্যদ্রব্য আমদানির বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। একইসঙ্গে দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে রাখার কাজটিও অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে করতে হবে। এক্ষেত্রে বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। বাজারের লাগামটা ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে না দিয়ে সরকারের হাতে রাখতে হবে। উন্নত দেশগুলো কোনো পণ্যের দাম বাড়াতে হলে ক্রেতাসাধারণকে আগেভাগেই জানানো হয়। শুধু তাই নয়, দাম কেন বাড়ানো হচ্ছে তার কারণও ব্যাখ্যা করা হয়। আমাদের দেশে বিনা নোটিশে যখন তখন দাম বাড়ানো হয়। ভোক্তার অধিকার তারা থোরাই কেয়ার করেন।
বহুজাতিক কোম্পানি ইউনিলিভার সাম্প্রতিক সময়ে তাদের প্রায় সব পণ্যের দাম বাড়িয়েছে। এই কোম্পানি সারা বিশ্বেই তাদের পণ্য বিক্রি করছে। উন্নত দেশে তারা কোনো পণ্যের দাম বাড়ালে ক্রেতাদের আগাম নোটিশ করে। আর বাংলাদেশে এর উল্টোচিত্র। এ নিয়ে গণমাধ্যমে রিপোর্ট করলে মামলার ভয় দেখায়। আসলে ক্রেতারা বেনিয়া গোষ্ঠীর হাতে জিম্মি। তারা কথায় কথায় ক্রেতাদের পকেট কাটবে। কিন্তু কোনো জবাবদিহি করবে না।
আমাদের দেশীয় কোম্পানিগুলিও মওকা খোঁজে। সুযোগ পেলেই এরা দাম বাড়িয়ে দেয়। কখনো কখনো সরকারকেও জিম্মি করে পণ্যের দাম বাড়িয়েছে। এ অবস্থা থেকে কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকারকে সুযোগ সন্ধানী ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। অবশ্য প্রতিযোগিতা কমিশন ইতিমধ্যেই বড় কয়েকটি কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করেছে। এই মামলা যেন শুধু লোক দেখানো না হয়!
অব্যাহত অর্থনৈতিক মন্দাবস্থার কারণে দেশে রিজার্ভের পরিমাণ দ্রুত কমে গেছে। রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়াতে হবে।
গত বছর বিপুল সংখ্যক জনশক্তি বিদেশে রপ্তানি হয়েছে। যা বিগত বছরগুলোর তুলনায় দেড়গুণ বেশি। নতুন বছরে নিশ্চয়ই একটা ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে। ব্যাংকে তারল্য সংকট কিংবা ডলার সংকট ব্যবসায়ীরাই সৃষ্টি করেন। দেশের বাজারও নিয়ন্ত্রণ করেন তারা। তারা যদি সরকারের সঙ্গে সহযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে অগ্রসর না হয় তাহলে সংকট থেকে উত্তরণের পথ নেই। বিষয়টা সরকারকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে পারলে অন্য সমস্যাগুলো কাটিয়ে ওঠা দুরহ হবে না।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অস্থিরতা কাটিয়ে ওঠার পাশাপাশি সরকারকে রাজনৈতিক উত্তাপ প্রশমনের উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারকে অনেক বেশি কৌশলী হতে হবে। ধারণা করা হচ্ছে, নতুন বছর রাজনৈতিক অঙ্গণ উত্তপ্ত হয়ে উঠবে। গেল বছরের রাজনৈতিক সংঘাতের উত্তাপ নতুন বছরে আরও বেশি ছড়িয়ে পড়তে পারে। দেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে। নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নানা হিসাবনিকাশ চলছে। জোট গঠন নিয়েও প্রধান প্রধান দলগুলো সলাপরামর্শ করছে। নির্বাচনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত না হলেও ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হবে।
এই নির্বাচনের সব প্রস্তুতি ২০২৩ সালের ডিসেম্বরেই শেষ করতে হবে। সেক্ষেত্রে সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের সবচয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে সব রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে আনা। সেই সঙ্গে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্পন্ন করা। কোনো কারণে অন্যতম প্রধান বিরোধীদল বিএনপি নির্বাচনে না এলে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। সরকার নিশ্চয়ই আগামী নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইবে না।
নতুন বছরে গণমাধ্যমকেও অনেক বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। সেই চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সত্যনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশের চ্যালেঞ্জ। সুসাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ। গেল বছরের সাংবাদিকতা আগের বছরগুলোর মতোই নানা কারণে প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। সত্যনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে অনেক বাধা-বিপত্তি ছিল। সাংবাদিকতার নামে হলুদ সাংবাদিকতা, এজেন্ডা সাংবাদিকতা, তোষামোদী সাংবাদিকতা বেশিমাত্রায় হয়েছে। এতে সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতা কখনো কখনো মুখ থুবড়ে পড়েছে। আমরা এ অবস্থার অবসান চাই।
গণমাধ্যম হচ্ছে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। কিন্তু এই স্তম্ভ নড়বড়ে হয়ে গেলে পুরো রাষ্ট্রীয় কাঠামোই নড়বড়ে হয়ে যায়। দেশের স্বার্থে, উন্নয়নের স্বার্থে এবং গণতন্ত্রের স্বার্থে গণমাধ্যমকে স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার দিতে হবে।
দ্বিধাহীন চিত্তে একটি কথা বলতে চাই। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কিন্তু এখনো চলছে। আমরা এখনো একটি যুদ্ধের মধ্যেই আছি। এখনো প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি সক্রিয়। এখনো পাকিস্তানপন্থীরা ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে চলেছে। উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠী বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ভাবমূর্তিতে কুঠারাঘাত করতে চায়। এসব অপশক্তির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সব মানুষের ঐক্য দরকার। এই ঐক্য সৃষ্টিতে গণমাধ্যম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ‚ ভুমিকা রাখতে পারে। আমরা নিশ্চয়ই এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে প্রস্তুত।
ঢাকাপ্রকাশ-এর পাঠক, লেখক, বিজ্ঞাপনদাতা, শুভাকাঙ্ক্ষী ও শুভানুধ্যায়ীদের জানাই নতুন বছরের শুভেচ্ছা। সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। ঢাকাপ্রকাশ-এর সঙ্গে থাকুন।
মোস্তফা কামাল: প্রধান সম্পাদক, ঢাকাপ্রকাশ ও কথাসাহিত্যিক।