বীরাঙ্গনা কোকিলা বেগমের বেঁচে থাকার লড়াই
১৯৭১ সাল একটা ইতিহাস। আমার জীবনটাও একটা ইতিহাস। ১৯৭১ সালের ইতিহাসের সঙ্গে আমার জীবনটা জড়িয়ে আছে অঙ্গাঙ্গিভাবে। যেভাবে জড়িয়ে জড়িয়ে থাকে তরুলতা, ঠিক সেভাবেই জড়িয়ে আছে একাত্তর আর আমার জীবন। তাই ভাবছি, কোথা থেকে শুরু করি। আবার কি বলবো, আর কি বলবো না এ-ও ভাবছি। শুধু একাত্তর নিয়ে কথা বলার আগে আমি আমার প্রথম জীবন সম্পর্কে জানাতে চাই। তখন বুঝা যাবে, একাত্তরের আগের জীবন আর পরের জীবন।
আর দশজন মানুষের মতন আমার শৈশবটাও ছিল মিষ্টি মধুর ঝকঝকে উজ্জ্বল, সুন্দর। গ্রামের সকলের মতন বেড়ে উঠেছি খেলাধুলা আর দুষ্টুমি করে। আমাদের গ্রামে সমবয়সী একদল দূরন্ত চটপটে ছেলেমেয়ে ছিল প্রায় ২২/২৫ জনের মতন। এই ২২/২৫ জনই সবসময় একসঙ্গে থাকতাম। প্রথম খেলা শুরু হয় পুতুল দিয়ে। তারপর হাড়িপাতিল, তারপর আস্তে আস্তে গোল্লাছুট থেকে শুরু করে যত রকমের খেলা আছে করতাম। আমরা অনেকে একসঙ্গে দল বেঁধে খেলতাম। কেনা খেলনা দিয়ে বসে খেলতাম না। আর আমাদের সময় ছেলেমেয়ের আলাদা করে তেমন কোন খেলা ছিল না। আমরা ছেলেমেয়েরা আলাদা করেও খেলতাম না। একই সঙ্গে খেলা করতাম। পুকুরে, নদীতে, বিলে যখন যেখানে সুযোগ-সুবিধা ছিল সেখানেই গোসল করতাম। পুকুর-নদী-বিলে গোসলের আলাদা একটা আনন্দ আছে। এতগুলো ছেলেমেয়ে একসঙ্গে কত কিছু করতাম। কারণ, একেক জনের মাথা থেকে একেক রকমের বুদ্ধি বাহির হতো। আর সেই রকমই শুরু হতো খেলা।
আমি ছিলাম তাদের নেতা, নেতৃত্ব দিতাম। সবাইকে আমার কথা শুনতে হতো। আমার কথার বাহিরে কেউ যেতে পারতো না। কারণ, আমি বুদ্ধি খরচ করে চলতাম। একই বয়সি এতগুলো ছেলেমেয়ের মাঝে প্রতিদিনই কারো না কারো সঙ্গে ঝগড়া লেগেই থাকতো। তাদের ঝগড়া আবার আমিই মিটমাট করে দিতাম। আবার যখন দেখতাম আমার উপর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, আমাকে তেমন একটা পাত্তা দিচ্ছে না, তখন আমি নিজেই কয়েকজনের সঙ্গে ঝগড়া লাগিয়ে দিতাম। তারা তখন ঝগড়া-মারামারি করে আবার আমার কাছেই এসে বিচার চাইতো। আমি তখন তাদের বিচার করে এক করে দিতাম। আর তখনই হতো আমার মজা। মনে মনে হাসতাম, গর্ববোধ করতাম। আর সবাই আমাকে বেশ সম্মান-ভয়-সমিহ করে চলত। কিন্তু আমার এই চালাকি একদিন ধরা পড়ে যায়। সেদিন আমার নিজেরই খুব খারাপ লেগেছিল। মনে হয়েছিল, সত্যি, মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছি আমি। তখন থেকে আমি নিজেকে পাল্টাতে থাকি। কিভাবে সবার মনে সুন্দর একটা জায়গা করা যায়, তা চিন্তা করতে থাকি। চেষ্টা করতে থাকি, ভাল হয়ে সুন্দরভাবে চলার। এমন সুন্দরভাবে চলবো, যেন সাত গ্রামের মানুষ আমার নাম শুনলেই দূর থেকে মনে মনে শ্রদ্ধা করে। একটা সময় এই অভ্যাসটা আমি করেই ফেলেছিলাম। শুধু বাড়ির না, এলাকার কম বেশি অনেক লোক আমাকে ছোটখাট কোন সমস্যা হলে ডাকতেন। আমার সঙ্গে আলাপ আলোচনা করতেন। তারা অবশ্য আমার কিছু বড় এবং আমার সমবয়সীরাও ছিল। একটা সময় দেখি, তাদের কাছে আমি কিছুটা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছি। বিষয়টা আমার বেশ ভাল লাগছে। একটা সময় এল, যখন মনে মনে একেবারে পরিবর্তন হয়ে গিয়েছি।
সময় তো থেমে থাকে না। আর আমার মনে হয়, কিছু কিছু সময় খুব দ্রুত চলে যায়। এটা আমার ধারনা। আসলে সময় তো সময়ের গতিতেই চলে, তাই না? কৈশোর পার হয়ে যৌবনে পা দিয়েছি। তখন হাতে গুনে বলতে পারবো না আমার বয়স কত ছিল। তবে এটা বলতে পারি, যৌবনে পরেছি। ১৯৭১ সাল। আনুমানিক ১৫/১৬ না হয় ২০/২২ তো হবেই। তবে ২০/২২ হবে না। যুদ্ধের অল্প কিছুদিন আগে আমার বিয়ে হয়। বিয়ের পর মাত্র কয়েকবার বাবার বাড়িতে আসা যাওয়া করেছি মাত্র। তখন তো আমি বাড়ির নতুন বউ। আমার সঙ্গে তখনো কারো তেমন ভাব জমে ওঠেনি। কথাবার্তা হয় সবার সঙ্গে। তবে তেমন একটা না। বাড়ি ভর্তি মানুষ, চেনাজানা হয়ে উঠেনি তেমন করে সবার সঙ্গে। আর কে কি লাগে, কে কেমন, সব তো আমাকে বুঝতে হবে। কেমন শ্বশুর-শ্বাশুড়ি, ননদ-দেবর সবাই। তাই দূরে দূরে থাকি একটু। কাজকর্মও করতে হয় না তেমন একটা। নতুন বলে কথা।
এরই মাঝে যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। যুদ্ধের আগে থেকেই শুনতাম দেশে নাকি যুদ্ধ হবে। দেশের পরিস্থিতি ভাল না। দিন দিন খারাপ হচ্ছে। সবারই মন খারাপ। দিনরাত শুধু চিন্তা করে। কি হবে দেশের, কি হবে তাদের। প্রায় দিনই দেশ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আমরা মহিলারা শুধু কান পেতে শুনি। তাছাড়া আমি তো নতুন বউ, আমি তো আর নিজ থেকে কোন কিছু জানতে চাইতে পারি না। একদম অল্প সময়ের মধ্যে গ্রামেগঞ্জে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে ভয় আরও বেড়ে গিয়েছে। বাড়ির মুরুব্বী এখানে সেখানে বসে বসে কথা-বার্তা বলে কি করবে। কিন্তু কি যে করবে তা ঠিক করতে পারেনা। এরই মাঝে শুনি বাজারে, থানায় এসব জায়গায় পাঞ্জাবী চলে এসেছে। এক সময় শুনি, থানা দখল করে নিয়েছে পাঞ্জাবীরা। থানায় থেকে থেকে সকাল বিকেল দুপুর নেই, যখন তখন গ্রামে এসে হানা দেয় আর যা ইচ্ছে তাই করে। যখনই শুনি গ্রামে পাঞ্জাবী প্রবেশ করছে, তখনই মৌমাছির দলের মতন গ্রামের সব বয়সী নর-নারী দৌড়ে পালাচ্ছি- যেখানে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পাচ্ছি। কখনো ক্ষেতের ভেতর, কখনো পাহাড়ের পিছনে। বাড়িঘর ছেড়ে যে যেখানে পেরেছে সেখানেই পালিয়েছে। আমি নতুন বউ। একা তো আর কোথাও পালাতে পারিনা। বাড়ির সকলে যেদিকে যায় আমাকেও সে দিকেই যেতে হয়। এই পলাপলি করে কি আর থাকা যায়।
যুদ্ধের শেষের দিকের কথা। মনে হয় বাংলা মাসের আশ্বিন/কার্তিক মাস হবে। এমন সময় আমরা মা-ঝিয়েরা ধরা পড়ি। মানে আমি আর আমার মা দু’জনে একই সঙ্গে ধরা পড়ি। একই দিনে, একই সময়ে, একই সঙ্গে। আমার বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি কাছাকাছিই, পাশাপাশি গ্রাম। একদিন আমি বাবার বাড়িতে যাই। পরদিন সকালে কটা বাজে বলতে পারবো না, তবে রোদ উঠে গিয়েছে। এমন সময় মানুষ বলছে, গ্রামে দলে দলে পাঞ্জাবী এসে গিয়েছে। এ কথা শুনে মা-সহ আমি, সঙ্গে গ্রামের বাড়ির আরও অনেক লোক দৌড়ে পালাচ্ছি। আমরা দৌড়ে যাচ্ছিলাম উত্তর দিকে। কিছুদুর যাওয়ার পর দেখি, অনেক বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। বাড়িঘর, গ্রাম দাউ-দাউ করে জ্বলছে। আগুন জ্বলছে তো জ্বলছেই। আগুন নেভাতে কোন মানুষ আসছে না। আগুন দেখে ভয় পেয়ে আমরা আবার উল্টা ঘুরে দক্ষিণদিকে যাই। কিছুদূর যাওয়ার পরই আমরা মা-ঝিয়ে একই সঙ্গে ধরা পড়ি। পাঞ্জাবীরা কোন দিক দিয়ে কখন কিভাবে এসেছে তা বলতে পারবো না। হঠাৎ দেখি, আমাদের সামনে একদল পাঞ্জাবী। আমরা তো কোন কিছু দেখার অবস্থায় ছিলাম না। তখন তো আমাদের একটাই চিন্তা- একটা নিরাপদ জায়গায় আমাদেরকে পালাতে হবে।
আমাদেরকে ধরে প্রথমে নিয়ে যায় মুরাদি ক্যাম্পে। ঐ ক্যাম্পে ফেলে কয়েক দফা নির্যাতন করেছে। বিকেলের দিকে একটু ক্ষান্ত হয়েছে। মনে হয়, যারা ঐ ক্যাম্পের সবাই দুইবার করে ক্লান্ত হয়ে একটু বিরতি দিয়েছে। আবার শুরু করেছে সন্ধ্যা রাত থেকে ভোর পর্যন্ত। সারা রাতই নির্যাতন করেছে আমাদেরকে। মুরাদি ক্যাম্পে আমাদেরকে কয়েকদিন রেখে তারপর নিয়ে যায় আজিরুদ্দি চেয়ারম্যান-এর বাড়িতে। চেয়ারম্যান বাড়িতেও রেখেছে বেশ কিছুদিন। তারপর নিয়ে যায় মেজর টিলার বাংকারে। ঐখানে নিয়ে গিয়ে দলে দলে পাঞ্জাবী দিনরাত বলে কথা নেই, একই কাজ করেছে।
কি বলি মা, লজ্জা শরমের কথা। হাঁটতে, বসতে পারতাম না। শরীরের কাপড় লাগলেও মনে হতো, যেন কেউ জোরে আঘাত করেছে। তার পরও পাঞ্জাবীরা রেহাই দেয়নি। হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে চলাফেরা করেছি। প্রসাব পায়খানা করতে পারতাম না। অনেক ব্যাথা হতো। না পারতাম সহ্য করতে, না পারতাম বলতে। বুকেও ছিল প্রচন্ড ব্যাথা। সব সময় টনটন করতো। একটুখানি স্পর্শ লাগলেই প্রচন্ড ব্যাথা করতো। তার পরও তারা কত কষ্ট দিয়ে দিয়ে নির্যাতন করেছে। একটু দয়ামায়া করেনি। যারা রান্না করতেন তাদেরকে বলতাম কষ্টের কথা। কান্নাকাটি করতাম। তখন তারা পাথর গরম করে এনে দিতেন। তারপর ছ্যাঁক নিতাম। ছ্যাঁক নিলে একটু ভাল লাগতো। নির্যাতনের সময় কষ্টটা কম লাগতো। দিন কি রাত, সবই ছিল সমান। যখন যার মনে চেয়েছে সেই এসেছে এবং তাদের ইচ্ছে মতন নির্যাতন করে চলে গেছে। আমাকে শত শত পাঞ্জাবী নির্যাতন করেছে। কত শতবার যে নির্যাতন করেছে তা বলা সম্ভব না। দিনে-রাতে ২৪ ঘন্টা মিলিয়ে কমপক্ষে ২০/২৫ জন থেকে ৩০ জন তো হবেই। সব গিয়েছে এই শরীরের উপর দিয়ে। কি যে কষ্ট হয়েছে, তা বুঝানোর মতন কোন ভাষা নেই আমার। আমি কোন ভাবেই বুঝাতে পারবো না সেই কষ্টের পরিমান।
শুধু যে নির্যাতন করেছে তা তো না, খাবারেও কষ্ট দিয়েছে। খাবার দিত পরিমান মত। খাবার দিয়ে আবার সময় দিয়ে দিত, এই দুই-চার মিনিটের মধ্যে খেতে হবে। জামাকাপড় পরতে দিত না। গোসল করার কোন সুযোগই ছিল না। তাই গোসল করতে পারিনি কোনদিন, এই তিন-চার মাসে, একদিন-একবারও গোসল করতে পারিনি। এই যে দিনরাত একজনের পর আরেকজন নির্যাতন করেছে, একবারও তো পরিস্কার করতে পারিনি। নিজের শরীরের চামড়া কেমন অচেনা হয়ে গিয়েছিল। নিজেকে নিজেই চিনতে পারতাম না। কেমন যেন একটা বিশ্রি দুর্গন্ধ হয়ে গিয়েছিল। নিজকেই নিজের ঘৃণা লাগতো। হাত দিয়ে শরীরের অন্য কোন জায়গায় ধরতে পারতাম না। ধরলেই ময়লা চলে এসেছে শরীর থেকে। চুলকাতে পারতাম না। একটু চুলকালেই নখের ভেতর ভর্তি হয়ে যেতো। নখও বানরের মতন হয়ে গিয়েছিল। আমাকেই আমার কাছে জঙ্গলের পশুর মতন লাগতো। আসলেই তো পশুর মতন হয়ে গিয়েছিলাম। কি যে ভয়ংকর অবস্থার মধ্য দিয়ে দিন পার হয়েছে, এসব বর্ণনা দিয়ে শেষ করার মতন না। জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনা মুখে বর্ণনা দেওয়া যায় না। সেই কঠিন সময়ের কথা যত বার মনে আসে, মন তত বার সেই কঠিন সময়ে চলে যায়। তখন আবার ভেতরটা ফেটে যায়। কাঁচের গ্লাস ফেটে গেলে অনেক সময় তার দাগটা দেখা যায় না। পানি কিন্তু চুয়ে চুয়ে পড়ে। পড়ে যাওয়াটাও দেখা যায় না। ঠিক আমার ভেতরটায় এমনই হয়। দেখা যায় না, ব্যাথার যন্ত্রনায় ভেতর শেষ হয়ে যায়।
দেশ স্বাধীন হলে, পাঞ্জাবীরা চলে গেলে আমরা সেই বাংকার থেকে বাহির হয়ে আসি। আমাদের তো কোন কাপড় ছিল না। আমাদের পরনের সব কাপড় খুলে নিয়ে গিয়েছিল পাঞ্জাবীরা। বাংকারে থাকা টুকরা টুকরা কাপড় সামনে ধরে বাংকার থেকে বাহির হয়ে আসি। বাংকার থেকে বাহির হওয়ার পর মনে হয়েছিল, এমন সুন্দর পৃথিবী তো আর কোন দিন দেখিনি। তখন নিজের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারিনি। ভুলে গিয়েছিলাম যে, আমার পরনে কাপড় নেই। কোথায় যাব, কি করবো দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম। তখন রাস্তায় মানুষ আমাদেরকে পাগল বলে ঢিল ছুড়ত, কত কি বলত।
আমাদের এ অবস্থা দেখে ফারুক মাষ্টার আমাদেরকে কাপড় দেন। গ্রাম থেকে, কারো বাড়ি থেকে এনে দেন। বাড়িতে এসে দেখি, বাড়িঘর বলে কিছুই নেই। পুড়া ভিটা পড়ে আছে। গ্রামের মানুষও আমাদেরকে জায়গা দেয় না। অনেক কষ্ট করে পুড়া বাড়িতে আমাদেরকে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। আমাদের বাড়িতেই আমাদের জায়গা দেওয়া হচ্ছে না। তখন গ্রামের যারা ভাল, তারা সবাইকে বলে বুঝিয়ে আমাদেরকে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দেয়। তারপর জল খাবার। কোথায় পাব খাবার। সব তো পুড়ে শেষ। শুরু হ’ল জীবন সংগ্রাম। আজও সেই সংগ্রাম করে যাচ্ছি বেঁচে থাকার জন্য।
আপনি তো শুধু শুনেই যাচ্ছেন। আপনি বুঝতেই পারছেন না, আমার ভেতর দিয়ে কি ঝড় বয়ে যাচ্ছে। আমার ভেতর দিয়ে যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে, তা বুঝানো সম্ভব নয়, আর কেউ বুঝবেও না। তাই বলি, বেঁচে আছি শুধু।
লেখক: মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও প্রাবন্ধিক
/এএস