স্বাধীন সার্বভৌম দেশে বহিঃশক্তির প্রভাব শোভন নয়
বাংলাদেশে গত নির্বাচনে রাতে ভোট হয়েছে এ বিষয়ে জাপানি রাষ্ট্রদূত প্রথমবারের মতো কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন যে, তিনি এটি প্রথমবার বাংলাদেশেই শুনেছেন। আর কোথাও তিনি একথা শোনেননি। তিনি আরও বলেছেন, আগামী নির্বাচনে এ রকম কোনো ঘটনা ঘটবে না বলে তিনি আশাবাদী।
একটি রাজনৈতিক ইস্যুতে একজন বিদেশি রাষ্ট্রদূতের পক্ষ থেকে এ ধরনের একটি মন্তব্য আসলে কতটুকু যুক্তিসঙ্গত সে বিষয়ে ইতোমধ্যেই অনেকেই কথা তুলেছেন। যেটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ইস্যুকে কেন্দ্র করে বিদেশি একজন রাষ্ট্রদূতের কথা বলা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত এবং সেটি কূটনৈতিক শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে কিনা সেটি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বিষয়টি সব মহলেই আলোচিত হচ্ছে।
সরকারের দিক থেকেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাদের ডেকেছে এবং এ বিষয়ে কথা বলেছে। বাংলাদেশ সরকার তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছে যে, তারা এ বিষয়ে কথা বলতে পারেন না অথবা এটি কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত কাজ। এটি আসলেই কতটুকু যৌক্তিক সেটি প্রথমত পরিষ্কার করা দরকার। একজন বিদেশি রাষ্ট্রদূত অবশ্যই তাদের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে যে, তারা কি বিষয়ে কথা বলতে পারবে, কি বিষয়ে কথা বলা উচিত হবে না, মূলত তারা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করবে। কারণ রাষ্ট্রদূতের কাজই হল, দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে ঘাটতি থাকলে সেটি কীভাবে উন্নয়ন করা যায়। কীভাবে সম্পর্কটিকে এগিয়ে নেওয়া যায়।
এ ছাড়া শুধুমাত্র কূটনৈতিক সম্পর্কই না, বাণিজ্য সম্পর্ক আছে, সাংস্কৃতিক সম্পর্ক, এ ছাড়া অন্যান্যক্ষেত্রে দুই দেশের যে ইস্যু থাকে সেগুলো নিয়েই তারা মূলত কাজ করে। কিন্তু রাষ্ট্রদূতেরা দেখা যায় আমাদের দেশে এসে তারা দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কথা বলেন। তাদের মত হল যে, তারা উন্নয়ন সহযোগী এবং তারা এ বিষয়ে কথা বলতে পারে। কিন্তু এটি কি তাদের দেশের সরকার অনুমতি দেবে কিনা সেটিও ভেবে দেখা দরকার। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ভারতে কোনো রাষ্ট্রদূত কখনোই কি অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ে কথা বলেছেন? তাহলে বাংলাদেশে কেন?
বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। সেখানে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো বলতে পারে, তাদের স্বার্থ আছে, তারা ক্ষমতায় যেতে চায়, তারা সরকারের সমালোচনা করবে। কিন্তু বিদেশি রাষ্ট্রদূতের কাজ এটি নয় যে, তারা সরকারের সমালোচনা করবে। সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলবে। এখন সরকার ক্ষমতায় আছে, জাপানের সঙ্গে যদি কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি হয়, তাহলে তার দায়-দায়িত্ব রাষ্ট্রদূতের উপরেই বর্তায়। রাষ্ট্রদূতের কাজ হলো— পজিটিভ বিষয় নিয়ে কথা বলা ও কাজ করা। নেগেটিভ বিষয়গুলো সে ঢেকে রাখবে, ভালো বিষয়গুলোকে সামনে নিয়ে আসবে। কিন্তু তিনি যেটি করলেন সেটি কোনো শিষ্টাচারের মধ্যেই পড়ে না। রাজনৈতিক দলগুলোও এ বিষয়ে তাদের নিয়ে নালিশ জানান।
আমি বলতে চাই, অন্যকে দোষারোপ করার আগে, আমরা যদি আমাদের নির্বাচন গোছানোভাবে করতে পারি, মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে পারি—তাহলে অন্যরা এসে আর এ সব কথা বলতে পারবে না। আর যতক্ষণ আমরা সেটি সঠিকভাবে করতে না পারব, অন্যেরা এটি বলতেই থাকবে। আমরা তাদের থামাতে পারব না।
কাজেই আমাদের এখন দরকার মানবাধিকার ও ভোটের অধিকার নিশ্চিত করা। দেশ শাসনের দায়িত্ব কারা পালন করবেন, সেটি দেশের জনগণ যাতে নির্ধারণ করতে পারে— সেই সুযোগটি আমাদের অবারিত ও নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
আরএ/