দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় বাড়িকেই ‘শেল্টার হোম’ বানানো উচিত
বিড়ালকে বলা হয় বাঘের মাসি। আমাদের এবারের সিত্রাং, যেটি হলো এটিকে আমি বাঘ বলতে চাই না। এটি একটা বিড়াল মার্কা সাইক্লোন হয়েছে। আমি কথাটিকে হালকাভাবে বললেও এটিই সত্যি। আমি বলতে চাচ্ছি যে, আমাদের বড় কোনো সাইক্লোন হয়নি। যদিও আমাদের বেশ কিছু উন্নতি হয়েছে এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায়। তবে একইসঙ্গে আমাদের অনেক সমস্যাও আছে।
প্রথম সমস্যা হচ্ছে যে, সাইক্লোনের সময়কাল। সাইক্লোন সাধারণত মার্চের মাঝামাঝি থেকে মে মাসের শেষ, এই ছয় সপ্তাহের মধ্যে হয়ে থাকে। আবার অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে ডিসেম্বরের শেষ, এই ছয় সপ্তাহের মধ্যে হয়ে থাকে। এখন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্ব বলছে যে, সাইক্লোনের তীব্রতা বিশ্বব্যপী বাড়বে। এখন থেকে বিশ ত্রিশ বছর পরে হয়তো আমি থাকব না তবে ঘন ঘন সাইক্লোন হতে পারে। কারণ, সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা যদি ২৬/২৭ ডিগ্রির উপরে উঠে যায়, বিষুবরেখা বরাবর, তাহলে এই নিম্নচাপগুলোর সৃষ্টি হয়। আমরা যেহেতু কর্কটক্রান্তি, বিষুবরেখা বরাবর তাপমাত্রা কিন্তু অনেক বেশি। সউদি আরবে প্রায় ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট। তাহলে এই নিম্নচাপ ঘন ঘন হবে। নিম্নচাপ হওয়ার পরে সাইক্লোনটি কোনদিকে যাবে, এটির কোনো বিজ্ঞান সম্মত ব্যাখ্যা নেই। এখন থেকে ৫০/১০০ বছর আগে যখন সাইক্লোন হতো, আমরা প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকতাম ।সাইক্লোনটি কোন দিকে যাবে? এখন গত আট দশ বছরে যে সাইক্লোনগুলো হয়েছে এগুলো কোথায় কীভাবে আঘাত করবে এই অনিশ্চয়তাকে মেনে নিয়েই আমাদের চলতে হবে।
আমাদের দেশের সেই ক্ষমতা নেই যে ঝড় আমরা উপকূলের কাছাকাছি এলে আমাদের রাডার সেটি ধরতে পারে। কিন্তু উপকূলের আকাশে বাতাসের নিম্নচাপ কোথায় এটি উন্নত বিশ্ব বলতে পারে। কাজেই আমাদের প্রথম কাজ হবে, উন্নত বিশ্বের সঙ্গে চুক্তি করে তাদের কাছে থেকে পূর্বাভাস নেওয়া। আমাদের পূর্বাভাস অনেকটা আমি বলব এ রকম স্টুপিডিটি পৃথিবীর কোথাও নেই। এবারে উয়ারনিং সিস্টেমে পৃথিবীর কোথাও কোনো সাইক্লোনের কোনো জোরই ছিল না। বাতাসের গতিবেগ ৮৯ কিলোমিটারের বেশি হলে সেটি ক্যাটাগরি-১ ।আর ২৫০এর মতো হলে ক্যাটাগরি-৫ ধরা হয়। আমাদের হয়েছে ৭০/৮০কিলোমিটার। অতএব এটি কোনোটির মধ্যেই পড়ে না।
আমরা জানি, অমাবস্যা পূর্ণিমায় সাইক্লোনগুলো বেশি হয়। এখন অমাবস্যা চলছে। কাজেই এই ভরা কাটাল যদি জোয়ারের সময় আসতো, তাহলে সাইকোনটি আরও দশ ফুট উপরে উঠতো। এটি এসেছে ভাটার সময়। যে কারণে জলোচ্ছ্বাসের প্রভাব খুব একটা পড়েনি। পড়েছে ঝড়ের প্রভাব। আমরা বেশি ভয় পাই জলোচ্ছ্বাসকে।
আরও একটি পয়েন্ট হল বাধ ভেঙ্গে পানি ঢুকে পড়েছে। কেন বাধ ভাংলো। ১৫ফুট উঁচু বাধ কেন ৩/৪ফুট পানির চাপে ভাংলো?আমরা এর জবাবদিহিতা চাই। পানি মন্ত্রণালয়কে এর জবাব দিতে হবে। সরকারকে এর জবাব দিতে হবে। বাংলাদেশ সরকার হাজার কোটি টাকার প্রজেক্ট নিচ্ছে। তাহলে আমরা ৫০০ কোটি টাকা খরচ করে বাঁধগুলো কেন মেরামত করতে পারি না! বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকবে কেন? আমরা এর জবাবদিহিতা চাই।
এরপর আমাদের দরকার সাইক্লোন শেল্টার। আমাদের প্রয়োজন নয় হাজার থেকে দশ হাজার। আমাদের আছে চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার। আমরা বলছি, সরকারিভাবে শেল্টার না বানিয়ে ব্যক্তিগতভাবে যাদের বাড়িঘর উপকূল এলাকায় আছে, তাদেরকে যদি একটি ঘর উঁচুভাবে বানাতে সাহায্য করা হয়, কিছু খরচ দেওয়া হয়, তাহলে এটিই তো একটি শেল্টার।
প্রত্যেকের বাড়ি যেন তার শেল্টার হিসেবে কাজ করে।আমি বলব, আমাদের দেশ যেহেতু প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবিলা করেই চলতে হয়। সেক্ষেত্রে সেই দূর্যোগ মোকাবেলাটুকু যেন অর্থবহ হয়। সেদিকে আমাদের লক্ষ্য রাখা জরুরি। ক্ষয়ক্ষতি যেন না হয় সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়াটুকু জরুরি। দূর্যোগ আসবেই। তবে সেটিকে ভয় পেয়ে নয়, মোকাবিলার মাধ্যমেই সেটিকে আমাদের সামাল দিতে হবে।
লেখক: শিক্ষাবিদ,পরিবেশবিদ ও পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ