পর্ব-১
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে সংশয়-হতাশা
বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় চালু হয় এরশাদ আমলে। এরশাদ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রণয়ন করে দেশে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদান কার্যক্রম চালু করেন। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুমোদন করে এ কার্যক্রম অব্যাহত রাখেন। যার ফলশ্রুতিতে এখন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রায় শতাধিক।
আমার মনে হয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইন কাঠামো আছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইন কাঠামো আছে, তার মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য আছে।
এটির মধ্যে একটি বড় পার্থক্য হলো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে এটিকে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য অনেক সীমিত করে ফেলা হয়েছে। অর্থাৎ ছাত্রছাত্রীরা এখানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়, কিন্তু তাদের অতি উচ্চ হারে বেতন ভাতা দিতে হয়। সেখানে অনেক সময় দেখা যায় যে, আবাসিক কোনো সুযোগ-সুবিধা থাকে না। শিক্ষা কখনো সংস্কৃতি খেলাধুলা ইত্যাদি ছাড়া সম্পন্ন হয় না।
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনেকসময় দেখা যায় একটি ভাড়া করা বাড়িতে, কমিউনিটি সেন্টারের উপরের তলায় এ সব জায়গায় তাদের ক্যাম্পাস তৈরি করে। সেখানেই তারা শিক্ষাদান কার্যক্রম চালু করে।
একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যখন শুরু হয়, মোটামুটি কিছু সুযোগ-সুবিধা নিয়ে একটি ক্যাম্পাস গড়ে তোলে তারপর সেখানে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা সেটি দেখি না। তা ছাড়া এ সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়েও জনমনে যথেষ্ট হতাশা ও সন্দেহ আছে।
আমরা দেখেছি যে, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আজকে অনুমোদন পেল আর কালকেই তারা ভাড়াবাড়িতে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম চালু করল। আমরা এমনও দেখেছি বাংলাদেশে একবছর হয়ত তাদের অস্তিত্ব ছিল তারপর তাদের ব্ল্যাক লিস্টেড করে দেওয়া হয়েছে। একসময় তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। সেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন আর নেই। কিন্তু সেসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যেসব ছেলেমেয়েরা স্নাতক ডিগ্রী নিয়ে বেড়িয়ে গেছে, এখন খোঁজ নিলে দেখা যাবে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো খোজ খবর নেই। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্তিত্বই নেই, সে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়ে আজ সে চাকরি প্রার্থী। সে বেঁচে আছে কিন্তু তার বিদ্যায়তনিক অস্তিত্ব সেটিইতো বিলুপ্ত হয়ে গেল।
এ ধরনের অসামঞ্জস্যতা দূর করতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ক্যাম্পাসগুলোতে ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা আমরা তৈরি করি। পর্যায়ক্রমে সেটি আস্তে আস্তে সম্প্রসারিত হয়। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে একই নিয়ম চালু হওয়া দরকার।
আমি বলছি, আজকে যদি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিয়ে দেওয়া হয়, তাকে শর্ত দিয়ে দিতে হবে, তাদেরকে নির্দিষ্ট পরিমাণ জমির মধ্যে ইত্যাদি ক্যাম্পাস করতে হবে। যে ছাত্রছাত্রীরা একটি ভাড়া বাড়িতে অথবা শপিংমলের উপরে লেখাপড়া করল, তাদের ক্যাম্পাসজীবন চার বছরের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। ক্যাম্পাস ছাড়া সে একটি ডিগ্রি নিয়ে বেরিয়ে গেল, তাহলে ক্যাম্পাসের অভিজ্ঞতা তার কোথায় হলো? তাকে আমরা প্রতারিত করছি। এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়।
একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় একটি গভঃমেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় মূলত একটি বিশ্ববিদ্যালয়। কোনটি জনগণের টাকায় কোনটি ব্যক্তি মালিকানায় পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে এগুলো মূলত বিশ্ববিদ্যালয়। আজকে উন্নত বিশ্ব অর্থাৎ যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা পেয়েছি সেখানে প্রাইভেট অথবা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো পার্থক্য করা হয় না। বরং অনেক ক্ষেত্রেই আমরা দেশি, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই শীর্ষে অবস্থান করছে। উদাহরণস্বরূপ— হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়। এটি আমেরিকার শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে অন্যতম। কাজেই আমি মনে করি প্রাইভেট এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে আমরা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যে বৈষম্য সৃষ্টি করি, সেটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। প্রকৃতপক্ষে আমরা সেই জায়গাটিতে পৌঁছাতে পারিনি।
লেখক: সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আরএ/