পর্ব-২
কৃষির পরেই প্রবাসী আয় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় চালক
এই প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রীর বিশ্ব মহামন্দার হুঁশিয়ারিকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে আমাদের খুবই বিচক্ষণতায় পা ফেলতে হবে। সেজন্য নিচে মোদ্দা কিছু নীতি অনুসরণ করা গেলে এই মহাসংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ অনেক দেশের চেয়েই ভালো করবে।
নীতি পরামর্শ:
এক. প্রধানমন্ত্রী যেমনটি বলেছেন কৃষিকেই আমাদের সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ হিসেবে গুরুত্ব দিতে হবে। সেজন্য যথোপযুক্ত বাজেটারি সহায়তা ছাড়াও সহজ শর্তে ঋণ, সম্প্রসারণ এবং মার্কেটিং সমর্থন দিয়ে যেতে হবে।
দুই. কৃষিভিত্তিক শিল্পের প্রসারের পাশাপাশি কৃষিপ্রক্রিয়াজাত পণ্যের রপ্তানি বাড়ানোর জন্য সবধরনের নীতি সমর্থন দিতে হবে।
তিন. বদলে যাওয়া গ্রাম বাংলায় অকৃষি খাতের প্রসারের জন্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের হাতে প্রয়োজনীয় পুঁজি যোগান দিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য অল্প সুদে পঁচিশ হাজার কোটি টাকার যে পুনঃঅর্থায়ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে তা দ্রুত বাস্তবায়নের দিকে মনোযোগ বাড়াতে হবে। বাস্তবায়নের গতি কতোটা তা দেখার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডিজিটাল মনিটরিং জোরদার করতে পারে। এই কর্মসূচি যেন অব্যাহত থাকে সেজন্য আরও পঁচিশ হাজার কোটি টাকার তহবিল পাইপলাইনে রাখা যেতে পারে।
চার. এই কর্মসূচির মধ্যে সোলার সেচ প্রকল্প যুক্ত করা উচিত। পাশাপাশি কৃষি যান্ত্রিকিকরণ কর্মসূচির অধীনে যে ভর্তুকির সুযোগ দেওয়া হচ্ছে তা এই সোলার সেচ উদ্যোগের জন্যও প্রযোজ্য করা হোক। বর্তমানে প্রায় চৌদ্দ লাখ ডিজেলচালিত সেচ পাম্প আছে। এর অর্ধেক পরিমাণও যদি সোলারে রুপান্তরিত করা যায় তাহলে একদিকে জ্বালানি আমদানি খরচ কমবে, অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশের সাফল্যের ঝুড়িতে নয়া উপকরণ যুক্ত হবে। কৃষকেরও দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ বাড়বে।
পাঁচ. ব্যাংকগুলোকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগে ঋণ দিতে উৎসাহী করার জন্য সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক মাধ্যমে ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিমের জন্য অর্থ বরাদ্দ করেছে। সোলার পাম্পকেও এই কর্মসূচির সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। তাহলে কৃষিতে বিনিয়োগের হার বাড়বে। প্রয়োজনে এই গ্যারান্টি স্কিমের জন্য বাজেটারি বরাদ্দ আরও বাড়ানো যেতে পারে।
ছয়. ন্যানো ক্রেডিট ও ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য ডিজিটাল ফাইন্যান্সের আওতায় ট্রেড লাইসেন্স ছাড়াই ঋণ দেওয়ার যে উদ্যোগ বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়েছে তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। আধুনিক কৃষি উদ্যোক্তাদেরও এই সুযোগ দেওয়া হোক।
সাত(১). কৃষির পরেই প্রবাসী আয় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় এক চালক হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। হালে নতুন করে অনেকেই প্রবাসী কর্মী হিসেবে বিদেশে যাচ্ছেন। এরা যাতে সহজেই উপযুক্ত রেটে তাদের বিদেশি আয় দেশে পাঠাতে পারেন সেদিকে নীতি সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো যেন তাদের ঠকাতে না পারে সেদিকে নজরদারি বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে হুন্ডির ক্ষেত্রগুলো উপড়ে ফেলার যে উদ্যোগ বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষ নিচ্ছে সেগুলোর ব্যাপ্তি আরও বাড়াতে হবে।
সাত(২). বড় আকারের প্রবাসী আয় দেশে আনার জন্য বিনিয়োগ বন্ড, ট্রেজারি বন্ডসহ নানাধরনের বিনিয়োগ যাতে সহজেই প্রবাসীরা করতে পারেন যে জন্য ডিজিটাল লেনদেনের যে উদ্যোগ বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়েছে তা আরও সহজলভ্য করতে হবে। এ বিষয়ে যথেষ্ট তথ্যও প্রবাসীদের দিতে হবে। এনআইডি সম্পর্কিত জটিলতা এবং বন্ড রিনিউয়াল জটিলতা দ্রুত দূর করে প্রবাসীদের মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে উৎসাহী করতে হবে।
আট. প্রবাসীদের সার্বজনীন পেনশন স্কিমে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যুক্ত করা ছাড়াও তাদের ছেলেমেয়েদের আগেভাগে বৃত্তি ও উপবৃত্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
নয়(১). প্রবাসী কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধির কর্মসূচিতে অগ্রাধিকার দেওয়া যেতে পারে। তারা যখন ছুটিতে দেশে আসেন অথবা চাকরি হারিয়ে দেশে ফেরেন তাদের জন্য বিশেষ দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে যুক্ত করার উদ্যোগ জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নিশ্চয় নিতে পারে।
নয়(২). প্রবাসীদের যারা ওয়ার ট্রান্সফারের মাধ্যমে প্রবাসী আয় পাঠান এবং ফ্রিল্যান্সিং এর অর্থ যারা দেশে আনেন তাদের কম রেটে ডলার বিক্রি করতে হয়। সব বিদেশি আয়কারকদের একই হারে ডলার বিনিময় হার দেওয়ার জন্য যে দাবি উঠেছে তা আমার কাছে যুক্তিসংগতই মনে হয়। এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
দশ. এরই কথা রপ্তানিকারকদের বেলাতেও খাটে। তারাই বা কেন কম রেটে ডলার বাঁচবেন। আমদানিকারকরাই বা বেশি দামে ডলার কিনবে। একটি বাজার নির্ভর বিনিময় হার সবার জন্য তৈরি করতেই হবে আমাদের। ভারত তো তা করতে পেরেছে। আমরা কেন পারব না?
এগারো. যে সব ব্যাংক রপ্তানি বা প্রবাসী আয় বেশি সংগ্রহ করতে পারছে না তাদের আমদানি দায় মেটানো বেশ কঠিন হয়ে পড়ছে। সেজন্য যেসব ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রার আয় বেশি তাদের একটি রেটের আশেপাশেই একটি ব্যান্ডের মধ্যেই ডলার বিক্রির নির্দেশনা কেন্দ্রীয় ব্যাংককেই দিতে হবে।
বারো. এ ছাড়া আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বা আর্থিক সংস্থা থেকে কম সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ সংগ্রহে বাংলাদেশ যথেষ্ট পারদর্শিতা দেখাচ্ছে। গুণমাণের প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি এনে এধরনের বিদেশি সহযোগিতা আরও বেশি বেশি সংগ্রহ করে যেতে হবে।
তেরো. বেশি সুদের কম সময়ের বাণিজ্যিক বা হার্ড টার্ম ঋণ নেওয়ার আগে দশবার চিন্তা করাই শ্রেয় হবে।
চৌদ্দ. বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর দ্রুত বাস্তবায়ন শেষ করে বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগ বাড়াতে আরও বেশি উদ্যোগী হতে হবে।
পনেরো. বাণিজ্যিক অর্থায়নের ওপর মনিটরিং বাড়িয়ে সহজেই বিদেশে অর্থ পাচারের ছিদ্রগুলো অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।
এরকম আরও অনেক নীতি পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে। সব অংশীজনের সঙ্গে বসে নিবিড় আলাপ করে নিয়মনীতি পর্যালোচনা করে নতুন করে স্মার্ট নীতি চালু করার সুযোগ নিশ্চয় আছে। এই সংকটকালে সবাইকে ধৈর্য ধরতে হবে। বাজারে প্যানিক ছড়ায় এমন কিছুই করা যাবে না। দীর্ঘদিন ধরে আমরা স্বকীয় দেশজ অনেক অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নীতি কৌশল আমরা উদ্ভাবন করেছি। পরীক্ষিত এ সব নীতিকাঠামোর ওপর ভরসা করে হিসেব করে এগুলে নিশ্চয় চলমান মন্দা বা আগামী দিনের মহামন্দা মোকাবিলা করেই বাংলাদেশের উন্নয়নের সুনাম ধরে রাখতে পারব। এজন্য সবাইকে একযোগে কাজ করে যেতে হবে।
লেখক: বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর
আগের পর্বটি পড়ুন>>>
বিশ্ব মন্দা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সময়োচিত সতর্কবার্তা
আরএ/