সামরিক বাহিনী বেসামরিক ভাষা বোঝে না
মিয়ানমার সামরিক বাহিনী দেশের ভেতরে দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে। একটি কথা খুবই স্পষ্ট যে, অং সান সু চির দলের যে সমর্থন ছিল সেটি এখন আর নেই। একসময় বহু নাগরিক সামরিক বাহিনীর গুলিতে মারা গেছে। যে কারণে এক ধরনের সিভিল কনফ্লিক্ট তৈরি হয়েছে মিয়ানমারের ভেতরে। এই দুর্বলতা থেকেই সামরিক বাহিনী বেশ মরিয়া হয়ে উঠছে।
একটি দেশের সামরিক শক্তি যদি দেশের অভ্যন্তরেই দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন তারা বহিঃবিশ্বে যুদ্ধের একটি আবহ তৈরি করার মাধ্যমে শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টা করে থাকে। মিয়ানমারও আসলে সেই চেষ্টা করেছে। বাংলাদেশ যেহেতু প্রতিবেশী রাষ্ট্র— এখন বাংলাদেশের সঙ্গে যদি দ্বন্দ্ব তৈরি করতে পারে সেটিকে তারা শক্তির অংশ মনে করে। এটি শুধু মিয়ানমার না, অনেক বড় রাষ্ট্রেও আমরা এরকম নীতি দেখেছি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন যেটি ত্বরান্বিত হওয়ার কথা ছিল, সেটিকে বিলম্বিত করার এটি একটি উপায়। তার মধ্যে যদি ছোটখাট যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিতে পারে বাংলাদেশের সঙ্গে তাহলে আরও ভাল হবে এমনটাই এরা মনে করছে।
প্রশ্ন হচ্ছে এখন বাংলাদেশ কি করবে? অনেকেই বলেছেন বাংলাদেশকে এর জবাব দিতে হবে। একইসঙ্গে বেসরকারি দল যারা আছে, তারা এজন্য সরকারকে দায়ী করছে। মিয়ানমার চায় বাংলাদেশের যদি বিভাজন বাড়ানো যায়, অর্থাৎ সরকারি দল অথবা বিরোধী দলে বিভাজন থাকলে তার রেসপন্সও দুর্বল হবে।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করা হচ্ছে। একাধিকবার তলব করে বলা হচ্ছে যে, এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তার বাইরে আরও একটি বিষয় থাকে, আন্তর্জাতিকীকরণ বিষয়টি। সেখানে আমরা যেটি দেখেছি, বাংলাদেশের বাইরে বিদেশি কূটনীতিক যারা আছেন, তাদের ডেকে বলা এবং তারা কি করতে পারেন সেটি নিয়ে আলোচনা করা যায় কি না ভেবে দেখা।
জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রী যখন ভাষণ দেবেন, সেখানে তিনিও হয়ত বলবেন। অন্যদিকে আন্তর্জাতিকীকরণ বাড়ানো দরকার। এমনকি নিরাপত্তা পরিষদেও বৈঠকে আলোচনা দরকার। আন্তর্জাতিক অনেক ধরনের ফোরাম আছে। একইভাবে অঞ্চলিকীকরণের বিষয়টিও বাড়ানো দরকার। আমার মতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কটিও বাড়ানো দরকার। দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় এখন পর্যন্ত ফলাফল হয়নি যদিও, যেহেতু সামরিক বাহিনী মিয়ানমারের ক্ষমতায় আছে, তারা হয়ত সামরিক ভাষাই বোঝে। তারা সিভিলিয়ান (বেসামরিক) ভাষা বোঝে কি না তাতে সন্দেহ আছে। এটি যদি বাড়তে থাকে তাহলে সমস্যা আরও বাড়তে থাকবে।
এ ক্ষেত্রে মিডিয়ার একটি বড় ধরনের ভূমিকা আছে বলে আমি মনে করি। মিডিয়া বাংলাদেশের ভালো যেমন দেখতে ভালবাসে, ঠিক তেমনি কোথায় ঘাটতি আছে সেটিও দেখা দরকার। একইসঙ্গে মিয়ানমারের বিষয়টিও আমাদের দেখতে হবে। আমি মনে করি, সেই মনযোগটুকু জরুরি। সেক্ষেত্রে তাদের ইন্টিলিজেন্স বাড়াতে হবে এবং বড় ধরনের মনযোগ দেওয়া উচিত মিয়ানমারের উপরে। এখন পর্যন্ত আমি তার অভাব দেখি। সিভিল সোসাইটিও কিন্তু কার্যত তেমন কোনো ভূমিকা নিতে পারেনি। সেটি বাড়ানো দরকার।
আন্তর্জাতিক মহলকেও মনযোগ দিতে হবে মনে করি। সরকারের উপর বিষয়টিকে ফেলে রাখা উচিত নয়। বিশেষ করে জাতীয় সংকট মোকাবিলায় যেখানে যুদ্ধ ভাবাপন্ন অবস্থা, সেখানে সবাই যদি সচেতন না হোন সমস্যা বাড়তেই থাকবে। কাজেই আমি মনে করি, সচেতনতার সঙ্গে সঙ্গে বড় আকারে ভালো কিছু কীভাবে করা যায় সে ব্যাপারেও চিন্তা ভাবনার দরকার আছে।
লেখক: অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্লেষক
আরএ/