সংকট মোকাবিলায় স্থানীয় জনসাধারণের ক্ষমতায়ন জরুরি
এ বছর ৬০ শতাংশ বৃষ্টি কম হয়েছে। আমি মনে করি কথাটি অসম্পূর্ণ। কোথায় কম হয়েছে? গড় হিসেবে যদি বলি, নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে যে বৃষ্টি হওয়ার কথা, তার তুলনায় দশগুণ বেশি বৃস্টি হয়েছে। জুলাই আগস্ট মাসে যে বৃষ্টি হওয়ার কথা তার তুলনায় অর্ধেক হয়েছে। তার মানে এটির প্রথম কথা আপেক্ষিক। মানুষ ও পরিবেশের জন্য আপেক্ষিক। এখন শরৎকাল শুরু হয়েছে।
এই সময়েও কিন্তু বৃষ্টি হয়। দক্ষিণ বাংলাদেশে বৃষ্টি হয় জুনের ১৫ তারিখ। ঢাকায় বৃষ্টি হয় জুলাইয়ের ৪/৫তারিখের দিকে। দিনাজপুরে বৃষ্টি হতো জুলাই মাসে। জুলাই আগস্ট বৃষ্টি হতো কিন্তু সেপ্টেম্বরে বৃষ্টি হতো না। ঢাকাতে সেপ্টেম্বরের ১৫ তারিখ পর্যন্ত ভালো বৃষ্টি হতো। বাংলাদেশের একেক জায়গায় বৃষ্টিপাতের বৈশিষ্ট্য একেক রকম। যেমন সুনামগঞ্জের উত্তরে মেঘালয়ে এপ্রিল থেকে বৃষ্টি শুরু হয়। এখন বৃষ্টি এবং বৃষ্টির সঙ্গে রিলেট করে বন্যা তার সঙ্গে বাংলাদেশের জন্য জরুরি যেটি সেটি হচ্ছে ফসলের সময়কাল।
বাংলাদেশে বিদেশিরা বোঝে না আমাদের কথা। কারণ, আমাদের কমপক্ষে তিনটি ফসলের সময়কাল আছে। ধানের জন্য আমরা বলি, আউশ, আমন ও বোরো। চৈত্র মাসের শেষ থেকে আষাঢ় মাস পর্যন্ত। নভেম্বর মাস থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত শুকনা মৌসুম। বৃষ্টি হওয়ার কথা নয়। বোরো ধান লাগানোর সময় সেজন্য সেচ দিতে হবে। সেচ আসবে কোথা থেকে? সেচ আসবে ভূগর্ভস্থ পানি থেকে। বর্তমানে আমরা গ্রাউন্ড ওয়াটারের উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল। যে কারণে বর্তমান সরকার বলছে ভূগর্ভস্থ পানি কমিয়ে সারফেস ওয়াটার ব্যবহার করতে হবে। দ্বিতীয় সময়কাল হচ্ছে আউশের সময়। এটি এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় থেকে মে পর্যন্ত। যেটি জুলাই আগস্ট পর্যন্ত ধান কাটা হবে। এটির পরিমাণ খুব কম এবং নিচু জায়গাতে এটি হয় এবং এই জায়গাগুলোতে পাট হয়। এখন বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাসে বৃষ্টি হলে পাট এবং আউশ করা সম্ভব।
আমাদের প্রধান ফসল হচ্ছে আমন। ইদানিং প্রধান ফসল হচ্ছে বোরো। আমন ধান লাগানো হয় জুলাইয়ের ১৫ তারিখ থেকে কোনো কোনো জায়গায়। বেশির ভাগ জায়গায় আগস্টের ১ তারিখ থেকে আগস্টের ৩১ তারিখ পর্যন্ত এ আমনের আবাদ চলে। এটি সেপ্টেম্বরের ১৫ থেকে ২০ তারিখের মধ্যে লাগালেও হবে। যত দেরি করে লাগাবে ফলন তত কমতে থাকে। এই ফসলটি হচ্ছে বৃষ্টি নির্ভর ফসল। আমরা যদি জুলাই মাসের ১৫ তারিখে লাগাতে পারতাম। রোপা ধান জুলাই আগস্টের বৃষ্টি এবং সেপ্টেম্বরে যতটুকু বৃষ্টি হয় তার উপর নির্ভর করে। আমার মতে এই যে ঋতু নির্ভর ফসল, পুরোনো বাংলায়, এখন থেকে পঞ্চাশ বছর আগে, প্রত্যেকটি ফসলের সঙ্গে, ঋতুর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। আম পাকবে কখন, তাল পাকবে কখন, প্রত্যেকটি ধানের ভ্যারাইটি সময়ের সঙ্গে, বৃষ্টির সঙ্গে নির্ভরশীল ছিল। আমাদের বৃষ্টি মোটামোটি জুনের মাঝামাঝি থেকে জুলাই আগস্ট সেপ্টেম্বরের ১৫ তারিখ পর্যন্ত প্রচুর বৃষ্টি হতো।
এই সময়ের ফসল ছিল আমন ধান।কৃষক আমন ধান পেত, তার জন্য সেচ অল্প দিলেও দিতে হতো, কিন্তু আল্লাহ বিনা পয়সায় পানি দেন বৃষ্টির মাধ্যমে। আমরা বোরো ধানের প্রচলন করেছি। যেটি ডিসেম্বর, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারিতে লাগানো হয় এবং এপ্রিল-মে মাসে কাটি এবং এই সময়ে প্রাকৃতিকভাবে বৃষ্টি হওয়ার কথা নয়। যে কারণে এর জন্য পুরো সেচ দিতে হয়।
এ বছর ধানের জন্য ভয় নেই। কারণ, এ বছর ধানের তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। বন্যা হয়েছে মে মাসের শেষে, জুলাই মাসে। তখন বোরো ধান কেটে নিয়ে চলে আসছি। আমন ধান লাগানো হয়নি। এখন লাগানো হচ্ছে।
এ বছর ২০২২সালে বর্ষাকালে বৃষ্টি স্বাভাবিক থেকে অনেক কম হওয়ার কারণে রোপা ধান ঠিকমত তৈরি করতে পারেনি। গত ১৫ দিন ধরে দেখছি স্থানীয় পর্যায়ে বৃষ্টি হচ্ছে।
আমাদের বর্ষাকালে বৃষ্টি যখন নামে তখন সারাদেশ জুড়ে নামে। শরৎকালে বৃষ্টি যখন নামে তখন উত্তরায় বৃষ্টি হচ্ছে কিন্তু আজিমপুরে বৃষ্টি নেই। আজিমপুরে বৃষ্টি হচ্ছে তো সাভারে বৃষ্টি নেই। টুকরো টুকরো জায়গায় বৃষ্টি হচ্ছে। আবার যেখানে সেচের ব্যবস্থা আছে, কৃষক বাধ্য হয়ে বর্ষাকালে সেচের ব্যবস্থা করছে। আমাদের ভয় হচ্ছে এই সেচটি হচ্ছে ভূগর্ভস্ত পানি থেকে। তাহলে এখনই যদি ভূগর্ভস্থ পানি দিয়ে সেচ করি, তাহলে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে যখন বোরো ধানের জন্য সেচ করতে যাব, তখন কিন্তু ভূগর্ভস্থ পানির সমস্যা হতে পারে।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল দিয়ে যতটুকু পানি আসত গঙ্গা, মধুমতি ও কুমার দিয়ে তার পরিমাণ খুব কমে গেছে। দক্ষিণ পশ্চিম বাংলায় সাতক্ষীরা বরগুনা বাগেরহাট দিয়ে প্রচণ্ড লবনাক্ততা বেড়েছে।
আকাশের দিকে তাকালে দেখবেন একদম নীল আকাশ। কিন্তু এই সময়ে কিছু কালো মেঘ থাকবার কথা। কাজেই নীল আকাশ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় কাব্য করা যেতে পারে। কিন্তু খাদ্যের ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে। বাংলাদেশ সরকার এ ব্যাপারে সজাগ। যে কারণে চালের উপরে ট্যাক্স কমিয়ে খাদ্য আমদানি করছে। দেশে প্রচুর চাল আমদানি হচ্ছে। সরকার ধারণা করছে বাংলাদেশে চালের মজুত এ পর্যন্ত যত ছিল তার চেয়ে বেশিই আছে। অর্থাৎ আমাদের খাদ্য ঘাটতির ভয় নেই বলেই সরকার আশ্বস্ত করছে।
আমাদের সারাদেশ জুড়েই সবজি হয়। কৃষকরা সবজি লাগানো শুরু করেছে। ফুলকপি, বাঁধাকপি শিম ইত্যাদি লাগানো শুরু হয়ে গিয়েছে এবং আগাম ফসল বাজারে আসা শুরু হয়েছে। সরকারকে শুধু এটুকুই বলতে চাই যে, তারা যেন মাঠ পর্যবেক্ষণ করেন। সে অনুযায়ী সেচের ব্যবস্থা, জলাবদ্ধতার ব্যবস্থা, বন্যার ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী হাতে ধরতে হবে, স্থানীয় জনসাধারণকে ক্ষমতায়ন করে এ কাজ করতে হবে। এ ছাড়া কোনো উপায় নেই।
লেখক: শিক্ষাবিদ,পরিবেশবিদ ও পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ