বিচারহীনতা দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের বড় অন্তরায়
বাংলাদেশে দুর্নীতি অনেক গভীর এবং ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করেছে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এর ব্যপকতা খুব বেড়েছে। যেটি আমাদের কনফারেন্সের মাধ্যমে আরও একবার প্রতীয়মান হলো। এটি নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না। এটির পেছনে অন্যতম কারণ হলো যারা দুর্নীতি করেন তারা আসলে নিজেদেরকে বিচারহীনতার মধ্যে বিবেচনা করেন। দুর্নীতি করে পার পাওয়া যায় এ রকম একটি বিশ্বাস তাদের মধ্যে ছিল। এই অবস্থান থেকে তারা মূলত অবারিতভাবেই দুর্নীতির মধ্যে নিমজ্জিত থাকছে।
দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে আমাদের যে আইনগত প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা আছে, যেটি আমি মনে করি সেটি পর্যাপ্ত । তবে সেই সক্ষমতাটুকু কেন ব্যবহার করা হয় না, এটি আমাদের প্রশ্ন। প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত শূন্য সহিষ্ণুতা সেটি বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে তারা কিন্তু দুর্নীতিতে আরও বেশি করে জড়িয়ে পড়েছে। যে কারণে দুর্নীতি, ঘুষ ইত্যাদি অন্যায়গুলো এভাবে বিস্তার লাভ করছে।
এটি নিয়ন্ত্রণের উপায় হলো যে, যারা দূর্নীতি করেন, আমাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে আইন আছে, দুর্নীতি দমনকারী যে সংস্থাগুলো আছে তার কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে যারা দুর্নীতি করেন তাদেরকে যেকোনোভাবেই হোক জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) ২০২১ সালের ‘দুর্নীতির ধারণা সূচকে’ বিশ্বের দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশে এক ধাপ এগিয়েছে। সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় গত বছর বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম হলেও এই বছর হয়েছে ১৩তম।
আর বিশ্বের কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় আগের বছর বাংলাদেশ ১৪৮তম দেশ হলেও এই বছর হয়েছে ১৪৭। তালিকার অবস্থানে পরিবর্তন হলেও আসলে বাংলাদেশের দুর্নীতির চিত্রের কোনো পরিবর্তন হয়নি। কারণ, বাংলাদেশের স্কোরের কোনো পরিবর্তন হয়নি। অন্য দেশের ভালো-খারাপ করার কারণে তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থানের অতি সামান্যই পরিবর্তন হয়েছে।
পৃথিবীর সবদেশেই কমবেশি দুর্নীতি হয়। আইনের সঠিক ব্যবহার ছাড়া, কঠোরতা ছাড়া দুর্নীতি নিয়ন্ত্রিত হয় না। অন্য যেকোনো অপরাধের মধ্যে দুর্নীতি একটি অপরাধ। যে অপরাধের বিচার হয় না, যে অপরাধীরা বিচারহীনতা উপভোগ করে, সেই অপরাধের অর্থাৎ অপরাধীদের বিস্তার ঘটবে এটিই স্বাভাবিক। আমাদের দেশে সেটিই হচ্ছে।
কাজেই এটিকে নিয়ন্ত্রণ করার উপায় হচ্ছে যে, যারা দুর্নীতি করেন, তাদের কঠোরভাবে শাস্তি দিতে হবে দৃষ্টান্তমূলক। কিন্তু সেক্ষেত্রে আমি মনে করি, শুধুমাত্র আইনের ব্যবহারই শেষ কথা নয়। আমরা মনে করি যে, সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। যারা সুদ ঘুষের বাণিজ্য করে তাদেরকে প্রতিবাদ করতে হবে। অনেকে বাধ্য হয়ে, অনেকে নিজেদের সুবিধা চরিতার্থ করতে ঘুষ দেন তাদেরকেও আমাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। তাদেরকে ঘুষ দেওয়া থেকে বিরত রাখতে হবে। সার্বিকভাবে পুরো সমাজব্যবস্থার মধ্যেই একটি দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের মানসিকতা তৈরি করতে হবে। যারা অপরাধ করে এবং নিজেদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে মনে করেন তাদেরকে বিচার, শাসনের ভেতর নিয়ে আসা জরুরি। কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয় সেটি বুঝাতে হবে। আইনের ফাকফোকড় দিয়ে এরা যেন কোনোভাবেই বেরিয়ে যেতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি