শিক্ষাব্যবস্থা সনদ সর্বস্ব হলে চলবে না
শিক্ষাক্রম একটি চলমান প্রক্রিয়া। এটি বিশ্বব্যপী চলমান প্রক্রিয়ার অংশ। মানুষের চাহিদা এবং যুগের প্রয়োজনে এটি পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা হয়ে থাকে। আমাদের এখানে দীর্ঘদিন সংস্কার হয়নি। একইভাবে চলতে গিয়ে বিশৃঙ্খলাও হয়েছে। দ্বিতীয়ত হল পরীক্ষার বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে শিক্ষার্থীদের মাঝে। যেটি পৃথিবীর বহুদেশেই নেই। ফিনল্যান্ডের দিকে তাকিয়ে দেখি, সেখানে কোনো পরীক্ষাই নেই। কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে ফিনল্যান্ড ওয়ান অব দ্য টপ কান্ট্রি। সেখানে পরীক্ষা দিয়ে মান নির্ধারণ হয় না। পরীক্ষা দিয়ে দক্ষতা যাচাই হয় না। কারণ, দক্ষতা যাচাই হচ্ছে নিয়মিত মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। শ্রেণিকক্ষভিত্তিক ধারাবাহিক মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে। সেখানেই বর্তমান শিক্ষাক্রম প্রস্তাবিত আছে।
পরিবর্তন আসতেই হবে। এটিকে আমরা সাধুবাদ জানাব। সেটি সময়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। সেক্ষেত্রে আমি অবশ্যই মনে করি শিক্ষাক্ষেত্রের এই পরিবর্তনের বিরুদ্ধতা না করে সেটিকে স্বাগত জানানো উচিত। শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। কারিকুলাম পাথরে খোদাই করা কিছু নয়।এটি সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়ার অংশ বলে আমি মনে করি।
আমাদের বাচ্চাদের আল্লাহ তায়ালা অনেক মেধা দিয়েছেন। তারা যেকোনোভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। যদি শিক্ষকদের সক্ষমতা থাকে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ইচ্ছা থাকে, অভিভাবকদের ইচ্ছা থাকে। কাজেই যারা মনে করেন কারিকুলাম দিনের পর দিন, যুগের পর যুগ পরিবর্তন হবে না, তারা ভুল বকছেন।
আমি বারেবারে যে কথাটি বলতে চাই, তা হলো শিক্ষকদের দক্ষতা, যার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সেইসঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা। আগে থেকে যে বৈষম্য ছিল সেই বৈষম্য যাতে না বাড়ে, নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করতে গিয়ে, সরকারতো ম্যাচিভ অনলাইন প্রশিক্ষণকোর্সও করিয়েছেন। সেটিতো করা হয়েছে। শিক্ষকরা প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেও শ্রেণিকক্ষে প্রশিক্ষণের বাস্তবায়ন করেন নাই। নিজের চোখে দেখেছি, ছবি দেখিয়ে বলছে, এটি মূল, এটি কাণ্ড ও এটি পাতা। আমি বলেছি, বাইরে গিয়ে কেন দেখান না? এই হল শ্রেণি কক্ষের ভেতরে শিক্ষকদের দক্ষতার প্রমাণ। এই জায়গাটি থেকে সরে আসতে হবে।পুঁথিগত বিদ্যা ও মুখস্ত বিদ্যা থেকে সরে আসতে হবে। দুনিয়া অনেক বদলে গিয়েছে। আমরা যদি তার সঙ্গে তাল মিলাতে না পারি তাহলে আমাদের বাচ্চারা আরও অনেক বেশি পিছিয়ে যাবে।
আমাদের দেশেই প্রমাণ আছে। এতগুলো পরীক্ষা দিয়ে গোল্ডেন জিপিএ পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন পায় না। এই গোল্ডেন এ+ দিয়ে আমি কী করব? ৭ থেকে ৯ শতাংশ মাত্র উত্তীর্ণ হল ভর্তি পরীক্ষায়। এর মাধ্যমে কী প্রমাণিত হয়? পরীক্ষাকেন্দ্রিক যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে আমাদের শিক্ষার্থীদের পিছু পা করিয়েছে।
শিক্ষাক্রমে কোনো বিভাজন থাকবে না। বিজ্ঞান, মানবিক, বাণিজ্য ইত্যাদি বিভাজন করেই আমরা শিক্ষার্থীদের আরেকটি জালের ভেতর ফেলে দিয়েছি। আজকে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা মানবিকে যায় না। মানবিকের শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানের ধারে কাছে যায় না। বিভাজনের তো কোনো দরকার নাই। সকলকে ন্যূন্যতম কতগুলো বিষয়ে পড়ালেখা করতে হবে এবং স্ব স্ব শ্রেণি ক্ষেত্রে পড়ালেখার পাশাপাশি দক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে।
শিক্ষাব্যবস্থা সনদ সর্বস্ব হলে চলবে না। কত ছাত্রছাত্রী জিপিএ ৫পেয়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো একটি বিভাগে ভর্তি হতে পারছে না। পরিবার থেকেই শিক্ষার্থিদের বিকাশ শুরু করতে হবে। মা-বাবাকে তার সন্তাদের দিকে নজর দিতে হবে। সেই নজর দেওয়া বলতে তাদের জিপিএ -এর বোঝা বাড়িয়ে দেওয়া নয়। বরং তাদের মেধা সুস্থভাবে বিকাশ হচ্ছে কি না সেদিকটি দেখতে হবে। তারপরের দায়িত্ব বর্তায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপরে। শিক্ষকদের দক্ষ করে তৈরি করা। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যেই একটি গলদ আছে। সেটি দূর করতে হবে। ক্রমপরিবর্তনশীল পৃথিবীর সঙ্গে আমরা বদলাইনি।
লেখক:সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা