পাকিস্তানের ভূত এখনো নামেনি
সেদিনটা কেমন ছিল? অন্যান্য দিনের মতোই রক্তিম ছিল সেদিনের পূর্বাকাশ। মেঘের আড়াল ভেঙে সূর্যের উঁকি দেওয়া। কিন্ত আসলেই কি তাই? ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের দিনটি ছিল শুক্রবার। সেদিন কি বাংলার আকাশে সূর্যোদয় ঘটেছিল?
সেদিনের পরিবেশ কি আর সমস্ত দিনের মতোই উজ্জ্বল ছিল? মানুষের মুখে কি হাসি ছিল সেদিন? দুর্বৃত্ত চক্রের অতর্কিত এক আক্রমণে একটা বিভ্রান্ত জাতি স্তব্ধভাবে একটা দুঃসহ কৃষ্ণ সময় অতিক্রম করছিল। জাতির বুকে যে অন্ধকার নেমে এলো সেই দিন, সেই অন্ধকার কাটানোর তো কোনো আলোর রেখা দেখা যায়নি। বরং, কতিপয় কণ্ঠের নারকীয় উল্লাস, কখনো কখনো মিলিটারির বুলেটের সাঁ সাঁ শব্দে প্রকম্পিত ছিল ঢাকা শহর। সব মিলিয়ে সেদিনের পূর্বাকাশ হয়ে উঠেছিল এক দানবিক রক্তিমসমুদ্র।
মনে হয় শহীদ মিনার সেদিন লজ্জায় মাথা নত করেছিল; মনে হয় একটি জনপদ মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল; মনে হয় দিগন্ত জুড়ে পাখির কূজন থেমে গিয়েছিল; মনে হয় ঘড়ির কাঁটারা চলতে ভুলে গিয়েছিল সেদিন।
’৭৫-এর ১৫ই আগস্টের ভোরের আযানে ছিল কান্নার ধ্বনি; ছিল বুকফাটা আর্তনাদ। জাতির জীবনে, মানুষের জীবনে মানবতার ইতিহাসের নৃশংসতম ঘটনাটি ঘটে গেল। অঙ্গার হয়ে গেল বাঙালির অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ, মানুষের বিশ্বাস।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ।’ কিন্তু সেই বিশ্বাসের ভিত তো উপড়ে গেল ঘাতকের হিংস্র খড়্গাঘাতে। ’৭৫-এর ১৫ই আগস্ট শেলের মতো বিদ্ধ হলো চেতনার মর্মমূলে। সমগ্র বিশ্ব হতবাক দৃষ্টিতে দেখল এক ইতিহাসের বাঁক বদল।
১৫ই আগস্ট আমাদের জাতীয় জীবনের সবচাইতে কলঙ্কিত দিন। ৭৫-এর এই দিনে বাঙালি জাতির শৃঙ্খল মোচনের মহাসংগ্রামের স্রষ্টা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল। আর এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়েই আমাদের মুক্তিসংগ্রামকে চেষ্টা করা হয়েছিল বিধ্বস্ত করতে; বাঙালির চেতনাকে বিনষ্ট করতে; অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধকে সংহার করাই ছিল সেই ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের নেপথ্য উদ্দেশ্য।
এটা শুধু একটা দিনের ষড়যন্ত্র নয়। মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্ন থেকেই তিল তিল করে যে ষড়যন্ত্রের জাল বপন করা হয়েছিল তারই উলঙ্গ প্রকাশ ১৫ই আগস্ট। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালির স্বাধীনতার লড়াই শুরু হওয়ার পর থেকেই অসংখ্য কাশিম বাজার কুঠির আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। সেখান থেকেই বিষধর নাগ এক এক করে বেরিয়ে আসে।
আমরা কেউ ভুলিনি। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশটাকে গড়ে তোলার জন্যে মহান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কি বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। দেশকে পুনর্গঠনের লক্ষ্যে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে এক কোটি বাঙালি শরণার্থীকে দেশে ফিরিয়ে আনা; মাত্র তিনমাসের মধ্যে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীকে ফেরত পাঠানো; একটা নবীন রাষ্ট্রের অনবদ্য সংবিধান প্রণয়ন; শতাধিক রাষ্ট্রের কাছ থেকে বাংলাদেশের স্বীকৃতি অর্জন; জাতিসংঘ, ন্যাম, ওআইসি, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনালসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ একটা নতুন রাষ্ট্রের জন্য ছিল নির্দ্বিধায় অবিশ্বাস্য অর্জন। এ যেন ভস্ম থেকে আবার ফিনিক্স পাখির মতো শূন্যে ডানা মেলা।
পাক বাহিনীর ধ্বংস করে যাওয়া দেশটিকে প্রায় শূন্য থেকে তিনি তিলে তিলে গড়ে তুলছিলেন। যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইনশৃঙ্খলায় নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন। ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ নবপ্রণীত সংবিধানের আলোকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৯৩টি আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। ২৩ মে বিশ্ব শান্তিতে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বিশ্ব শান্তিপরিষদ বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ পুরস্কারে ভূষিত করে। ১৯৭৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ২৯তম সাধারণ পরিষদের সভায় বঙ্গবন্ধু প্রথমবারের মতো বাংলায় বক্তব্য দেন। কিন্তু পাকিস্তানি স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রতিশোধ স্পৃহা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছিল। বিস্তৃত হচ্ছিল ষড়যন্ত্রের বহুমুখী স্তর। তার-ই ছাপ আমরা ছত্রে ছত্রে দেখতে পাই বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরের জামানায়। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীদের লক্ষ্য ছিল একাটাই-মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত অর্জন, চিন্তা-চেতনা-বিশ্বাস ও আদর্শকে এক ঝটকায় পাকিস্তানমুখী করা এবং ধর্মের লেবাসে পুরো জাতিকে ঢেকে ফেলা। আর এটাই ছিল এই কলঙ্কিত অধ্যায়ের প্রকৃত পটভূমি। এই একটি মাত্র ঘটনার ভেতর দিয়ে দেশের মানুষের বোধ-ভাবনা-চিন্তা-চেতনা-আদর্শ সব কিছু পুনরায় পাকিস্তানমুখী করার কঠিন কাজটি খুব সহজেই করতে পারে চক্রান্তকারীরা।
এই হত্যাকাণ্ড শুধু বঙ্গবন্ধু পরিবারের ওপরই ঘটেনি, এই গুলিবর্ষণ করা হয়েছে বাংলাদেশের বুকের ওপর। পুরো বাংলাদেশকে রক্তাক্ত করে দেয়া হলো এক রাতের মধ্যে। এক রাতের মধ্যে বাংলাদেশকে এমন এক বিপর্যয়ের মধ্যে নিয়ে যাওয়া পৃথিবীর ইতিহাসে এত দ্রুত, এত বড় বিপর্যয় কখনো কোথাও ঘটেনি। শুধু সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা নয়, অসংখ্য হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল। ১৫ আগস্টের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী আমাদের নেতৃস্থানীয় শ্রেষ্ঠ সন্তানদের খুঁজে খুঁজে বের করে হত্যা করা হলো। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের সেই সমস্ত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গে হত্যা করা হয় বাঙালি জাতির স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্ক্ষা, আস্থা ও বিশ্বাসকে। হত্যা করা হয় বাঙালি জাতির ঐতিহ্য ও ইতিহাসকে। একটি রাতের ওই একটি ঘটনার ভিতর দিয়ে এমন অসংখ্য হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সাড়ে তিন বছর পর বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানের যে বিজয় নিশান উড়িয়ে দেওয়া হলো, তার অভিঘাতটি ছিল সুদূরপ্রসারী। এমন কী এখনো, বঙ্গবন্ধু হত্যার ৪৭ বছর পরও, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ভেতর দিয়ে পাকিস্তানি যেই প্রেতাত্মা আমাদের ঘাড়ে চেপে বসেছিল, সেই প্রেতাত্মাকে পুরোপুরি দমন করা যায়নি।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনরুদ্ধারের কথা আমরা বিভিন্ন সময় যেভাবে বলে এসেছি, অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, আমরা সেখানে এখনো পুরোপুরি সফল হইনি। ব্যর্থতার জায়গাগুলোকে আমরা ধরতে পারিনি। ষড়যন্ত্রের ক্ষেত্রগুলোকে আমরা ঠিক সময়ে চিহ্নিত করতে পারিনি। এই ষড়যন্ত্র ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে এক রাতের মধ্যে দানা বাঁধেনি। এর শেকড় আরও অনেক পেছনে, আরও অনেক গভীরে। বলা যায় আমাদের স্বাধীনতা সৌধের ইটগুলোকে একটা একটা করে টেনে খুলে ফেলা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে চক্রান্তকারীরা দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই নানা ধরনের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ সরকারের প্রতিটি দপ্তরে বহাল রেখেছিলেন পাকিস্তান সরকারের আমলাদের। সদ্যস্বাধীন দেশের প্রভাবশালী আমলারা যদি অসৎ হন, বিশ্বাসঘাতক হন, তাহলে তারা পদে পদে সরকারকে অপদস্থ করতে পারেন। অতি সহজেই তারা দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের জালে জড়িয়ে পড়েন। এর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ ১৯৭৪ সালের লবণ সংকট। ওই বছর প্রথম দিকে বাংলাদেশে লবণের ‘দুর্ভিক্ষ’ দেখা দেয়। প্রতি সের লবণের দর লাফিয়ে লাফিয়ে ওপরে উঠে একেবারে ৬০ টাকায় গিয়ে দাঁড়ায়। অথচ তখন চট্টগ্রাম বন্দরে পর্যাপ্ত লবণ জমা ছিল। বঙ্গবন্ধু এ ব্যাপারে তদন্ত করতে গিয়ে জানতে পারলেন, রেল ওয়াগনের অভাবের অজুহাতে আমলারা চট্টগ্রাম থেকে লবণ আনতেন না, তাই লবণের দাম আকাশছোঁয়া। বঙ্গবন্ধু আমলাদের ওপর ভরসা না রেখে নিজ উদ্যোগে চট্টগ্রাম থেকে লবণ আনার ব্যবস্থা করেন। ফলে লবণের দাম কমে যায়। কিন্তু এর আগেই যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। চক্রান্তকারীরা লবণের দুর্ভিক্ষকে তাদের কাজে লাগিয়ে নিয়েছে।
আমরা দেখেছি, রুশ বিপ্লবের পর ১৫-২০ বছর সেদেশের জনগণকে কঠিন দুঃখ-কষ্টের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। ওই সময় সোভিয়েত রাশিয়ায় খাদ্যের অভাবে বহু লোকের প্রাণও গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর চীন, ভিয়েতনাম ও পূর্ব ইউরোপের কমিউনিস্ট দেশগুলোও একই অবস্থার শিকার হয়। একই ধরনের অসুবিধা ভোগ করে বিপ্লবোত্তর আলজেরিয়া, কিউবাসহ বিভিন্ন দেশ। বাংলাদেশেরও তা-ই হচ্ছিল। কিন্তু চক্রান্তকারীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা চক্রান্তের অংশ হিসেবে এদেশের মানুষের মনে এই ধারণা দেয় যে, স্বাধীনতা হলো একটি আশ্চর্য জাদুর কাঠি, এর ছোঁয়ায় নিমেষেই মরুভূমিতেও দুধের নদী বয়ে যায়। নিমেষেই মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দূর হয়ে যায়। হ্যাঁ, তা হয় বৈকি! কিন্তু নিমেষেই নয়। ক্রমান্বয়ে। সবাই মিলে দেশগঠনের সংগ্রামের ভেতর দিয়ে।
বঙ্গবন্ধু সেই কাজটিই শুরু করেছিলেন। আর বলেছিলেন, ‘গাছ বুনলেই ফল হয় না। ফল পেতে দেরি করতে হয়। বীজ থেকে গাছ, গাছ থেকেই ফল আসে। বাংলাদেশ স্বাধীনতার বীজ বুনেছে। তা থেকে গাছও হয়েছে। তবে পাকা ফল পেতে অপেক্ষা করতে হবে। আমি পাঁচ বছরের মধ্যে আপনাগোর কিছু দিবার পারুম না।’
স্বাধীনতার পর প্রথম দুই বছর অর্থাৎ ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর সরকার কোনো রকমে সামাল দেয়। এক্ষেত্রে তখন প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র ভারত অনেকখানি সহায়তা করেছিল। কিন্তু ’৭৪ সালে খাদ্য সংকট আরও বৃদ্ধি পায় এবং ভারতেও তখন খাদ্য সংকট দেখা দেয়। তাই ভারত থেকে বাড়তি কোনো সাহায্য আসার পথ বন্ধ হয়ে যায়। উপরন্তু দেশে আঘাত হানে ভয়াবহ বন্যা। আর চক্রান্তকারীরা এই সুযোগ কাজে লাগায়। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাজার থেকে যে খাদ্য খরিদ করেছিল, সেগুলো সময়মতো যেন জনগণের হাতে এসে পৌঁছতে না পারে সেজন্য তারা নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ফলে দেখা দেয় খাদ্যসংকট। তারই অনিবার্য পরিণতিতে হয় দুর্ভিক্ষ। এমা রথচাইল্ড ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষের জন্য সরাসরি মার্কিন সরকারকেই দায়ী করেন। ‘ফুড পলিটিকস’ শিরোনামের প্রবন্ধে রথচাইল্ড লিখেছেন, ‘১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ বাণিজ্যিক বাজার থেকে মার্কিন খাদ্য খরিদ করে। কিন্তু আমেরিকার খাদ্যনীতির কারণেই ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ। ১৯৭৪ সালের গোড়ায় বাংলাদেশ তার প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য খরিদ করার জন্য কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করে। তখনকার বাজারদর অনুযায়ী খাদ্যের দাম ছিল অত্যন্ত চড়া। কথা ছিল বাংলাদেশ ওই খাদ্যশস্য ধারে পাবে। তবে সেই ধার হবে স্বল্পমেয়াদি। ১৯৭৪ সালে গ্রীষ্মকালে বাংলাদেশে বিদেশি মুদ্রার দারুণ অভাব দেখা দেয়। মার্কিন সরকারের কাছ থেকে যে ঋণ পাওয়ার কথা ছিল, মার্কিন সরকার সে ঋণ দেয়া তখন স্থগিত করে। তাই শরৎকালে বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য আমদানির জন্য যে দুটি মার্কিন খাদ্য-ব্যবসায়ী সংস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি হয়েছিল; সে চুক্তি বাতিল করে দেয়।’
অন্যদিকে, আমেরিকার পিএল-৪৮০ কার্যসূচি অনুযায়ী বাংলাদেশে খাদ্য সাহায্য পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ ওই বছরই কিউবার কাছে পাট বিক্রি করায় আমেরিকা ক্ষিপ্ত হয়ে বাংলাদেশে খাদ্য-সাহায্য পাঠানো বন্ধ করে দেয়। পরে অবশ্য মার্কিন অফিসাররা গোপনে অনেক পরামর্শ করে ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসে খাদ্য পাঠান। ততদিনে দুর্ভিক্ষে বাংলাদেশের যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গেছে।
ষড়যন্ত্রকারীরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে খাদ্য কিনে এবং সেগুলো নষ্ট করে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল, এর প্রমাণ সাংবাদিক পরেশ সাহার বইয়েও উল্লেখ আছে। পরেশ সাহার ভাষায়, ‘১৯৭৪ সালের ভয়াবহ বন্যার পর আমি বাংলাদেশে যাই। তখন ঢাকার অন্তর্গত সাভার বন্দরের জনৈক ব্যবসায়ী আমাকে জানান, তিনি ক’টি বিদেশি সংস্থাকে চাল সরবরাহ করতেন। তাকে বলা হয়েছিল, ওই সংগৃহীত চাল বাংলাদেশের ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য বিতরণ করা হবে। কিন্তু তিনি জানতে পেরেছেন, ওই চাল দুঃখী মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হয়নি, বাংলাদেশের খাদ্য সংকট আরও শোচনীয় করার জন্য ওইসব চাল সুন্দরবনের নদীগর্ভে ডুবিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তিনি জানান, গোপন সূত্র থেকে ওই খবর পাবার পর তিনি বিদেশি সংস্থাকে চাল সরবরাহ বন্ধ করে দেন।’
দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে বঙ্গবন্ধু মানসিকভাবে ভীষণ ভেঙে পড়েন। সাংবাদিক পরেশ সাহা ‘মুজিব হত্যার তদন্ত’ বইতে লিখেছেন, ‘১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় শেখ মুজিব কোনো রাতেই ঘুমাতে পারেননি। সারা রাত তিনি তার বাসভবনের বারান্দায় পায়চারি করেছেন। খাদ্যমন্ত্রী মোমিন সাহেবকে ডেকে বলেছেন, কিছুই লুকিয়ো না। না খেতে পেয়ে আমার বাংলার কত লোক মরছে, তার সত্য হিসাব জাতীয় সংসদে পেশ করো।
দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলে সফর করতে গিয়ে ক্ষুধার্ত মানুষকে বুকে জড়িয়ে ধরে তিনি কেঁদেছেন আর কেঁদেছেন।’
সেসময় দেশের আইন-শৃঙ্খলা তলানিতে নেয়ার মাধ্যমে জনগণের জীবন আরো অতিষ্ঠ করে তোলার জন্য অহর্নিশ পাক-মার্কিন ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। দেশপ্রেমহীন ও পাকিস্তানি দূষিত মানসিকতার দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীরাও ক্রমশ সাহসী হয়ে উঠতে শুরু করে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সেসব চক্রান্তের খবর আমাদের কানেও তখন এসেছিল। আমার সম্পাদনায় ২০১১ সালে দৈনিক কালের কণ্ঠে প্রকাশিত ‘ইতিহাসের কাছে এ আমার দায়’ শিরোনামের নিবন্ধে এ ব্যাপারে আমি বিস্তারিত লিখেছি। তার কিছু অংশ এখানে পুনরায় উল্লেখ করছি: পঁচাত্তর সালের কথা। আমি তখন ইত্তেফাকের সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে কাজ করি। পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় নিয়মিত ছাপা হয় আমার একটি অনুসন্ধানী রিপোর্টিং সিরিজ। নাম ‘ওপেন সিক্রেট’। সিরিজটা বেশ পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করার কারণে বিভিন্ন সংবাদ সূত্র (নিউজ সোর্স) আমার কাছে চলে আসত। ঠিক সেভাবেই একদিন দুপুর ১২টা নাগাদ অফিসে একটা টেলিফোন এলো। সম্ভবত ৭৫ সালের মার্চের গোড়ার দিককার কথা। আমি অফিসে বসে লিখছিলাম, অপারেটর ফোনটা থ্রু করলো রিপোর্টিং টেবিলে আমার কাছে। রিসিভার তুলে দেখি, ও প্রান্তে আছে আমার কৈশোরের সহপাঠী ও বন্ধু শাহাদত চৌধুরী, সাপ্তাহিক বিচিত্রার। সে তখনও সম্পাদক হয়নি, তবে মোটামুটিভাবে বিচিত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। শাহাদত আমাকে বলল, ‘তোকে একটা বোম ফাটানো ‘ওপেন সিক্রেট’ লেখার মসলা দিতে পারি। সাহস করে লিখতে পারবি?’ বললাম, ‘আমি ভয় পাই না সে তো তুই জানিসই। বল, কীভাবে পাব!’ সে বলল, ‘সাড়ে তিনটায় তোর অফিসের নিচে একজন গাড়ি নিয়ে আসবে, খবর পাঠালে চুপচাপ চলে আসবি।’
গাড়ি এলো কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে তিনটায়। স্টিয়ারিংয়ে একহারা সুদর্শন সুবেশী এক যুবক। একটানে গাড়ি নিয়ে গেল দৈনিক বাংলার নিচে। শাহাদত নেমে এলো। আমাদের নিয়ে গাড়ি চলল বাংলা মোটরের দিকে। আমরা কেউ কথা বলছি না, যেন এক রহস্যময় অভিযানে যাচ্ছি। আমি জানি না গাড়ি কোথায় যাচ্ছে। যুবকটি গাড়িটা নিয়ে গেল ক্যান্টনমেন্টের ভেতর। তখন ক্যান্টনমেন্ট এখনকার মতো এত ইমারতে ঠাসা ছিল না। আর ক্যান্টনমেন্ট সম্পর্কে আমারও তেমন কোনো ধারণা ছিল না। বলতে পারব না কোনো পথ দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো একটি বাংলো ধরনের বাড়িতে। তখন বিকাল সাড়ে ৪টা হবে। মনে হলো শাহাদত বাড়িটা চেনে এবং সম্ভবত গৃহকর্তাকেও। কারণ, আমরা যখন বাংলোর লনে রাখা চেয়ারে বসলাম, তখন সুন্দরী গৃহকর্ত্রী এলেন হাসিমুখে। শাহাদত তার নাম ধরে সম্বোধন করল এবং আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল মেজর ডালিমের স্ত্রী ‘নিম্মি’ বলে। প্রসঙ্গটা ওঠাল শাহাদতই। বেইলি রোডের লেডিজ ক্লাবে অনুষ্ঠিত এক বিয়ের অনুষ্ঠানে কিভাবে এক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছিল, তারই সবিস্তার বিবরণ। বোধহয় শাহাদতের ইচ্ছা ছিল এই ব্যাপারটা নিয়ে আমি ইত্তেফাকে একটা রিপোর্ট লিখি। কিংবা হতে পারে ইচ্ছাটা ছিল অন্য কারও, যা প্রকাশিত হয়েছে শাহাদতের মাধ্যমে।
আমরা যখন লনে কথা বলছিলাম, তখন বাংলোর একটি কক্ষ থেকে ছয়-সাতজন তরুণ সেনা কর্মকর্তাকে বের হতে দেখলাম। শাহাদত তাদের একজনের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিল, মেজর ডালিম। শ্যামলা, সুদর্শন। মেজর ডালিম তার বন্ধুদের সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দিল। তাদের মধ্যে তিন-চারজনের নাম লিখে রেখেছিলাম পরে আমার রিপোর্টে। কর্নেল ফারুক, কর্নেল রশীদ, মেজর নূর, কর্নেল শাহরিয়ার। পরে শাহাদতের কাছ থেকে জেনেছি, ঘাতকচক্রের আরও কয়েকজন ছিল এবং ওখানে ওদের গোপন বৈঠক হচ্ছিল। ওরা ঘর থেকে বেরিয়ে আসার পর কর্নেল ফারুককে খুব উত্তেজিত মনে হচ্ছিল এবং তার কথাবার্তাও ছিল বল্গাহীন। রশীদকে মনে হচ্ছিল শান্ত, স্বল্পভাষী এবং নীরব পর্যবেক্ষণকারী। মেজর নূরকে দেখলাম, নিস্পৃহভাবে একটা কাঠি দিয়ে পাঁচিলের একটা গর্ত খোঁচাচ্ছে। মেজর ডালিম আমাকে বারবার অনুরোধ করছিল লেডিজ ক্লাবের ঘটনাটা লেখার জন্য। ওদিকে কর্নেল ফারুক সক্রোধে বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিষোদগার করছিল এবং কর্কশকণ্ঠে আমাকে বলছিল, ‘ইউ উইল সি, দেয়ার ইউল বি আ ন্যাশনাল ইস্যু ভেরি সুন।’ (তুমি দেখো, শিগগিরই একটা জাতীয় ইস্যু তৈরি হবে।) যতই আমার বন্ধু শাহাদত, মেজর ডালিম ও তার স্ত্রী আমাকে লেডিজ ক্লাবের ঘটনা নিয়ে লেখার জন্য পীড়াপীড়ি করুক না কেন, আমার মস্তিষ্কের গভীরে তখন ‘ওপেন সিক্রেট’-এ এক বিপজ্জনক প্রতিবেদন দানা বাঁধছে। বারবার মনে হচ্ছিল, লেডিজ ক্লাবের ঘটনা পত্রিকায় ছাপানোর উদ্দেশ্য এক ক্রমঘনায়মান ষড়যন্ত্রকে আড়াল করার প্রয়াস মাত্র। কিন্ত ওই বিপজ্জনক স্থানে বসে আমার মানসিক অস্থিরতার বহিঃপ্রকাশ সঠিক হবে না অনুমান করে নীরব থাকলাম।
সন্ধ্যায় আমি ফিরলাম আমার অফিসে। শাহাদত হাটখোলায় তার বাড়িতে। পথে শাহাদত জিজ্ঞেস করল, ‘স্টোরিটা কেমন বলে মনে হয়?’ বললাম, ‘দারুণ’! শাহাদত বলল, ‘তুই ভালো বুঝিস কী লিখবি, কিভাবে লিখবি!’ অফিসে ফিরে লিখলাম রিপোর্ট-লেডিজ ক্লাবের ঘটনার বিন্দুমাত্র উল্লেখ তাতে নেই-আছে কিছুসংখ্যক তরুণ সেনা কর্মকর্তার গোপন বৈঠক এবং ক্ষোভের বিস্তারিত বিবরণ আর আসন্ন বিপর্যয়ের আভাস। শিরোনাম ছিল ‘তরুণ সেনা কর্মকর্তাদের গোপন বৈঠক’ শোল্ডার হেডিং এবং মূল হেডিং ‘সেনা বিদ্রোহের আশঙ্কা’।
রাতে লেখাটা সরাসরি প্রেসে পাঠিয়ে দিয়ে চলে গেলাম বাড়িতে। তখন বার্তা সম্পাদক মরহুম আসফউদ্দৌলা রেজা। আমার লেখার ওপর তার এতখানি আস্থা ছিল যে তিনি স্ক্রিপ্ট দেখতে চাইতেন না। আমি বাসায় ফিরে ভাবছি একটা দারুণ চাঞ্চল্যকর ‘ওপেন সিক্রেট’ ছাপা হবে পরদিন। কিন্ত দেখলাম, পরদিন রিপোর্টটা ছাপা হয়নি। রেজা ভাই টেলিফোনে জানালেন, চিফ ফোরম্যান খন্দকার বজলুর রহমান আমার লেখা নিয়ে রেজা ভাইকে দিয়ে বলেছিলেন, “রেজা সাহেব, এই ‘ওপেন সিক্রেট’টা নিয়ে ছোট সাহেবের (আনোয়ার হোসেন মঞ্জু) সঙ্গে কথা বলেন।’’ রেজা ভাইয়ের কাছ থেকে বিষয়টি শুনে সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু লেখাটি না ছাপানোর নির্দেশ দেন এবং আমাকে বলা হয়, আমি যেন ‘ওপেন সিক্রেট’ সিরিজটি বন্ধ করে দিই।
সেই মুহূর্তে আমার কাছে ‘ওপেন সিক্রেট’ সিরিজের চেয়ে পরিস্থিতিটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। পাকিস্তান আমলে একসময় আমার চিফ রিপোর্টার ছিলেন তাহেরউদ্দিন ঠাকুর। তিনি তখন বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রভাবশালী তথ্য প্রতিমন্ত্রী। গেলাম তাঁর কাছে, খুলে বললাম ঘটনার কথা, আশঙ্কার কথা। জানতাম, তাহের ঠাকুর বঙ্গবন্ধুর খুব বিশ্বস্ত। তাই চাইলাম, তিনি যেন বঙ্গবন্ধুকে খুলে বলেন সব কিছু। ১৫ আগস্টে বুঝেছিলাম, কী ভুল জায়গায় কথা বলেছিলাম আমি। ’৭৫ সংঘটনের পরবর্তী পর্যায়ে জেনেছি পুরো ঘটনার কুশীলবদের কেন্দ্রীয় চরিত্র খন্দকার মোশতাক হলেও এই তাহের উদ্দিন ঠাকুর ছিলেন তাদের অন্যতম এক কুশীলব। তখন যেদিকেই পা বাড়াই সেদিকেই অন্ধকার দেখি। ওদিকে রেজা ভাইয়ের সঙ্গে খন্দকার মোশতাকের ছিল দারুণ খাতির। আর খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে ইত্তেফাকের সম্পর্কও ছিল অত্যন্ত নিবিড়।
আমার অজ্ঞাতসারেই আমার রিপোর্টের ওপর কঠোর নজরদারি চলতে থাকল। সেদিকেও আমার কোনো ভ্রূক্ষেপ ছিল না। মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম বিষয়টি বঙ্গবন্ধুর কাছে পৌঁছানোর জন্য। কিন্ত বঙ্গবন্ধুর চারপাশ তখন আমার নাগালের অনেক বাইরে। সেনাবাহিনীর উচ্চপর্যায়ের দু’জনকে চিনতাম-একজন ব্রিগেডিয়ার মনজুর এবং অন্যজন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, চিফ অব জেনারেল স্টাফ। যোগাযোগ করলাম খালেদ মোশাররফের সঙ্গে। তিনি আমাকে বললেন, তার সঙ্গে কুমিল্লা-বেলোনিয়ায় যেতে। সেখানে তিনি আমার কথা শুনবেন একান্তে। গেলাম কুমিল্লা। সঙ্গে নিলাম বন্ধু ইকবাল সোবহান চৌধুরীকে। সে তখন বাংলাদেশ অবজারভারের রিপোর্টার। ফেরার সময় খালেদ ভাই আমাকে তার গাড়িতে উঠিয়ে নিলেন। আমি সবিস্তারে আমার আশঙ্কার কথা বললাম। তিনি শুনলেন গভীর মনোযোগের সঙ্গে। তারপর আমাকে আশ্বস্ত করলেন যে ব্যাপারটা তিনি দেখবেন। আমি তার কথায় আস্থা রেখেছিলাম বটে, কিন্ত আশ্বস্ত হতে পারিনি। কারণ, বারবার কর্নেল ফারুকের সেই কঠিন উচ্চারণ আমাকে শঙ্কিত ও কণ্টকিত করে রেখেছিল। অবশেষে ঘটেই গেল পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট। সেদিন যদি আমার ওই রিপোর্টটা প্রকাশিত হতো, তাহলে হয়তো বাংলাদেশের ইতিহাস এত ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ দ্বারা মসিলিপ্ত হতো না। পরে একসময় বন্ধু শাহাদতকে বলেছিলাম পুরো ঘটনাটা লেখার কথা। সে বলেছিল, ‘এখনো সময় আসেনি, বন্ধু। চারদিকে ওদের জাল ওরা বিছিয়ে রেখেছে।’
জাল এখনো ছিন্ন হয়নি। তবে যতটুকু ছিন্ন করা গেছে, তার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার। দীর্ঘ নির্বাসন শেষে ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা বাংলার মাটিতে ফিরে আসার মধ্য দিয়ে শুরু হয় বাংলাদেশের নতুন অধ্যায়। আজ বাংলাদেশের যত ইতিবাচক অর্জন, তার প্রায় সবটুকুই বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার অবদান। আমাদের পরম সৌভাগ্য যে, আমরা পেয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর মতো মহান নেতার, যিনি আমাদের পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। আর পেয়েছিলাম শেখ হাসিনার মতো দূরদর্শী নেত্রী, যিনি গড়ে তুলছেন একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। কিন্তু নাগিনীরা এখনো বিষাক্ত নিঃশ্বাস ফেলছে, এখনো নতুন নতুন ষড়যন্ত্র নতুন নতুন উপায়ে ডালপালা মেলছে। পুরনো শকুনেরা বঙ্গবন্ধুর আজীবনের লালিত স্বপ্নের দেশ-মাতৃকাকে গ্রাস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত সর্বত্র-সর্বদা।
এটাই স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম-রাত্রি যত ঘন হয়, ধীরে ধীরে ভোরের আগমনী বার্তাও দিনের আলোর প্রতিশ্রুতি নিয়ে ততই নিকটে আবির্ভূত হয়। সেভাবেই এই বাংলায়ও দীর্ঘ অমানিশার ঘোর অন্ধকার কেটে গিয়ে মুক্তির সূর্য ঠিকই উঁকি দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণের কর্মযজ্ঞ ছুটে চলেছে দুরন্ত গতিতে। বঙ্গবন্ধু প্রতি মুহূর্তেই বিশ্বাস করতেন, বাংলাদেশ হবে অসাম্প্রদায়িক চেতনার আবাস।এখানে ধর্মকে ব্যবহার করে মানুষের ভেতরে বিভেদ তৈরি করা যাবে না। তিনি বলতেন, ‘পৃথিবী আজ দুইভাগে বিভক্ত শোষক আর শোষিত, আমি শোষিতের পক্ষে’ এবং সেভাবেই তিনি সমস্ত কর্মযজ্ঞকে সাজিয়েছিলেন। মানবিক মূল্যবোধ, সৎ এবং স্বচ্ছ জীবনের ভেতর দিয়েই একটা জাতির মেরুদ-কে শক্তিশালী করার মূল মন্ত্রকে তিনি প্রতিটি বাঙালির মনে প্রোথিত করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষ মানুষের জন্যে, জীবন জীবনের জন্যে। এটাই ছিল তার আজীবনের সাধনা। দেশ এবং দলকে এইভাবেই তিনি তৈরি করেছিলেন। আজ এই দিনে জানতে হবে-আমরা জাতির জনকের সেই জীবনবোধ, সেই বিশ্বাস, সেই আদর্শ ও চেতনাকে কতখানি ধারণ এবং বহন করে আছি। বাংলাদেশকে এগিয়ে যেতে হবে তারই নির্দেশিত পথে। জাতির পিতার স্বপ্নকে সামনে রেখে এই বর্ণচোরাদের সঙ্গে নিরন্তর যুদ্ধ করেই সামনের দিকে এগোতে হবে।
জাগো বাহে, কোনঠে সবাই। জয় বাংলা।
লেখক: সম্পাদক, দৈনিক কালবেলা ও জাগরণ