দূর্বাঘাসের ফাঁকে উঁকি দেওয়া বেবী সেরনিয়াবাত
বন্ধু নিয়ে কিছু উক্তির মধ্যে একটি উক্তি ‘নতুন বন্ধুদের ভিড়েও স্কুলের বন্ধুরা মনে একটা আলাদা জায়গা করে থাকে।’ সত্যিই কিছু বন্ধু আছে যারা বন্ধুদের স্মৃতি ভুলতে পারেন না। হৃদয়ের মণিকোঠায় রেখে দেন, স্মৃতি মনে করে অশ্রুসিক্ত হন। তেমনি এক বন্ধুর কথা স্মরণ করে লিখছি এই স্মৃতি কথা। সময়টা ১০.০৮.২০২১। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ছোট বোন খাদিজা বেগম লিলির কন্যা ডলি জামানের অফিসার্স ক্লাবে বিয়ের অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। সেই বিয়েকে কেন্দ্র করে বঙ্গবন্ধুর মেজো বোনের মেয়ে একটি কমলা রংয়ের গ্লাস নাইলন কাপড়ের পোশাক তৈরি করেন। একই রকম পোশাক তৈরি করেন তার সহপাঠী কুমকুম। দুই বন্ধু একসঙ্গে বিয়ের অনুষ্ঠানে আনন্দ করেন। এই ছিল শেষ দেখা তার সঙ্গে। এই কথা বলতে বলতে কান্নায় ভাসেন। মনে করেন, বিদ্যালয়ে সাদা বরফের আইসক্রিমে হজমি মিশিয়ে খাওয়ার স্মৃতি।
বিদ্যালয়ের মাঠে খেলাধুলার স্মৃতি। ভীষণ চঞ্চল ছিলেন তিনি। এই চঞ্চলমতি মেয়েটির নাম বেবী সেরনিয়াবাত। বঙ্গবন্ধুর সেজো বোন আমেনা বেগমের ছেলে এবং প্রাক্তন পানিসম্পদ ও বিদ্যুৎ বিষয়ক মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের কন্যা বেবি সেরনিয়াবাত। ১৯৬০ সনে ২৪ এপ্রিল বরিশালে কালিবাড়ী রোডে জন্মগ্রহণ করেন। ইউনিভার্সিটি অব ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন তিনি । পরবর্তী কালে ধানমন্ডি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে তিনি সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। দশম শ্রেণিতে পড়াকালীন জীবনের মায়াত্যাগ করে চলে যান।
শার্ট প্যান্ট পরে বড় বোনের স্বামী ব্যারিস্টার তোফায়েলুর রহমানকে বলতেন, দেখেন তো, দুলাভাই কেমন লাগছে? তার এই আচরণে সবাই ভীষণ আনন্দ পেতেন। এখনো সেই স্মৃতি মনে করেন বোনেরা। তারা ছিলেন ছয় বোন, তিন ভাই। ছয় বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট বোন।
বড় বোন হুরুন্নেসা মঞ্জু বলেন, বেবী মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে পারত। অনেক সময় দরিদ্রদের নিজের জামা দিয়ে দিত।
আর এক বোন হাবিবুন্নেছা সেরনিয়াবাত শিউলির স্মৃতি কথায় দেখা যায়, একদিন মিন্টো রোডে তিনি আর বেবী ঘুরছেন, এক সময় এক বাদামওয়ালার কাছ থেকে ১০ টাকার বাদাম কিনতে চাইলে তিনি ১০০ টাকার বাদাম দেন। তিনি বাদামওয়ালাকে জিজ্ঞেস করেন, কি ব্যাপার, এতগুলো দিলে কেন? বাদামওয়ালা উত্তর দিয়েছিলেন, আপা মনি আমাকে মাঝে মাঝেই সাহায্য করেছেন বলেই আমি এখন কিছু করে খেতে পারছি। তিনি এই স্মৃতি এখনো মনে করেন আর ভাবেন। কতটা উদার ছিল তার ছোট বোনটি।
বেবী সেরনিয়াবাতের আর এক বোন হামিদা সেরনিয়াবাত বিউটি। ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫-এর আগের রাতে তাদের বাড়িতে দাদির মৃত্যুবার্ষিকী। সবাই কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল জানি না। প্রচণ্ড শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। ঘুমের ঘোরে প্রথমে কিছু বুঝতে পারলাম না। ছোট বোন বেবীকে ধাক্কা দিলাম বেবীও উঠে পড়েছিল। স্পষ্ট হলো, চারদিকে গুলির আওয়াজ। আমরা দুবোন দৌড়ে আব্বা আম্মার রুমে গেলাম। মা চিৎকার করে আব্বাকে বলেন, মিয়া ভাইয়ের (বঙ্গবন্ধু) বাসায় টেলিফোন করে দেখ। আব্বা টেলিফোনে বড় মামার (বঙ্গবন্ধুর) সঙ্গে কথা বলেন ছোট বোন বেবী দৌড়ে গিয়ে আবার টেলিফোন করে মামাকে বলল, মামা আমাদের বাঁচান। আমরা ভয়ে সব জড়োসড়ো। বাচ্চাদের মেঝেতে শুইয়ে রাখা হয়েছিল। ওরা ‘সারেন্ডার সারেন্ডার’ বলে চিৎকার করে রুমের মধ্যে ঢুকে পড়ল। ১৫/২০ জনের মতো। সবাই সশস্ত্র। আমরা সবাই হাত উঁচু করে দাড়িয়ে পড়লাম। বলল, ভয় পাবে না, সবাই নিচে নেমে আসুন। ছোট বোন বেবী বলে উঠল, ভয় পাব কেন? আল্লাহ ছাড়া কাউকেই ভয় পাই না। সবাইকেই একদিন মরতে হবে। ভীষণ সাহসী ও একরোখা ছিলেন বেবি। মাত্র দুহাত দূরত্বের মধ্যে থেকে শুরু হলো ব্রাশফায়ার। পরে তিনি জ্ঞান হারান। এদিকে তৎকালীন রমনা থানার ওসি শেখ আনোয়ার হোসেন আহতদের নিয়ে যান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পথে যেতে যেতেই তিনি প্রায় মৃত্যু পথযাত্রী ছিলেন। মেডিকেলে নেবার পর সেখানেই মৃত্যুকে বরণ করেন বেবি সেরনিয়াবাত।
রাজধানীতে কারফিউ পড়ে গিয়েছে এ কথা শুনে এদিকে তার বন্ধু কুমকুমের মা ঢাকা মেডিকেলে পড়ুয়া মেয়েকে হোস্টেল থেকে আনার জন্য গিয়ে দেখেন, মেঝেতে বেবী সেরনিয়াবাত পড়ে আছে। গায়ে সেই কমলা রংয়ের পোশাকটি। কানে ছিল সোনার রিং। তার পাশাপাশি আরিফ আব্দুল্লাহ, সুকান্ত, এবং বাসার কাজের লোক পড়ে আছে। ট্রলিতে পড়ে আছে আব্দুর রব সেরনিয়াবাত এবং শেখ মনি। মৃত্যুর এই খবর কুমকুমের মা এসে বললেন। কুমুকুম তার সহপাঠীর সঙ্গে বানানো পোশাকটি বহু বছর পরেননি। আলমারিতে সযতনে রেখে দিয়েছিলেন।
বেবি সেরনিয়াবাত গান শেখার জন্য ছায়ানটে ভর্তি হয়েছিলেন। তার ভাই আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ যিনি নিজেও আহত হয়েছিলেন, সেদিনের ঘটনায় তিনি বেবি সম্পর্কে বলেন, ‘মুছে যাওয়া দিনগুলো আমায় যে পিছু ডাকে’ গানটি বেবি বেশি শুনত’। সুন্দর গান গাইতে পারত। ভীষণ মিশুক ছিল আমার বোন। ঘাতকের বুলেটে ঝাঁজরা হয়েছিল আমার বোনের হৃৎপিণ্ডটা।
এমন একজন অকুতোভয় নারী বেঁচে থাকলে হতে পারতেন আদর্শ বধূ, মা ও সমাজসেবক। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের শহীদদের সঙ্গে বনানী গোরস্থানে বেবি সেরনিয়াবাত তার উচ্ছ্বল কৈশোরকে সঙ্গী করে চিরতরে শুয়ে আছেন। ক্ষণজন্মা কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘হদিশ’ কবিতায় লিখেছিলেন-ক্ষত বিক্ষত চলেছি হাজার, তবুও একা/সামনে বিরাট শত্রু পাহাড় আকাশ ঠেকা/কোন সূর্যের পাইনি দেখা।’ বেবী সেরনিয়াবাতেরা পৃথিবীতে আসে আবার চলে যায়। মিশে যায় মাটির সঙ্গে জেগে থাকে দূর্বাঘাসে ফুটে থাকে ফুল হয়ে। কিন্তু বেবী সেরনিয়াবাত আসে না। পায় না আলোর দেখা।
লেখক: অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়