অর্থনৈতিক অবকাঠামোগত সমস্যা দূর করা জরুরি
অর্থনীতির বর্তমান কঠিন সময় নিয়ে অনেকের অনেক কথা আছে। আমি বিষয়টিকে দুই ভাগে ভাগ করে দেখতে চাই। প্রথমত, বর্তমান মূল্যস্ফীতি, ইউক্রেন যুদ্ধ, খাদ্য ও জ্বালানি সংকট, রিজার্ভের উপর চাপ বা টাকার মান কমে যাওয়ার মতো দিকগুলো সামাল দেওয়ার বিষয়টি আমাদের সরকারের ব্যবস্থাপনা ও নীতির ওপর নির্ভর করছে। নানা কৌশল অবলম্বন করে অনেক দেশ এগুলো সামাল দিচ্ছে, দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। মুদ্রার মান বা রিজার্ভ পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য আমাদের সরকারও কিছু কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এটা একটা দিক। এর সঙ্গে আমি যেটাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি, তা হলো বাংলাদেশের মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণ ও এসডিজির লক্ষ্য অর্জনের বিষয়টি। শুধু সংকট মোকাবিলার দিকে সব নজর দিয়ে আমরা যেন অর্থনৈতিক উত্তরণের বিষয়টিকে বাধাগ্রস্ত না করি।
আমি মনে করি, বর্তমান সংকট মোকাবিলা ও অর্থনৈতিক উত্তরণ মানে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তর ও এসডিজির লক্ষ্য অর্জন-এই দুটি ক্ষেত্রে সমান্তরালভাবে কাজ করতে পারাই আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তবে বর্তমান পরিস্থিতির জন্য আমি গত এক দশকের উন্নয়ন প্রক্রিয়ার কাঠামোগত সমস্যাকেও দায়ী করতে চাই।
আমার মতে তিনটি সংকট আমাদের রয়েছে। প্রথমত, উন্নয়নের একমাত্রিক দর্শনে আমরা বাংলাদেশকে আটকে ফেলেছি। উন্নয়ন বলতে আমরা বৃহৎ অবকাঠামোকে ধরে নিয়েছি। কিন্তু উন্নয়নের অনেক সূচক রয়েছে। স্বাস্থ্য সূচকে আমরা কোথায় আছি? স্বাস্থ্যসেবা নিতে মানুষের নিজের পকেট থেকে খরচ বাড়ছে, সেবার মান খারাপ হচ্ছে। দূষণের কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে, শিক্ষার মানের অবনতি হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে নজর দেওয়াকে আমরা উন্নয়ন দর্শনের বাইরে রেখেছি। এই যে পরিস্থিতি, এটা শুধু সংকট নয়, এটা আসলে স্ব-আরোপিত একটি ফাঁদ। সুষম উন্নয়নদর্শন থেকে আমরা দূরে সরে গেছি।
রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার সংকট। দীর্ঘ সময় ধরে এটা চলে আসছে। সবকিছুতে রাজনৈতিক বিচার-বিবেচনার কারণে মেধা ও দক্ষতার মূল্যায়ন হচ্ছে না। সবকিছু হচ্ছে দলীয় বিবেচনা থেকে। মেধা ও দক্ষতার মূল্যায়ন না হওয়ায় অর্থনৈতিক ক্ষতি রয়েছে। আগে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী বা আমলাদের বেতন-ভাতা কম ছিল। যেকোনো বিবেচনায় তাদের এখন মাত্রাতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, আমলাতন্ত্রের দক্ষতা কি বেড়েছে? এডিপি বাস্তবায়নের অবস্থা দেখলেই তা টের পাওয়া যায়। দক্ষতার ঘাটতি, লাগামহীন খরচ, যথাসময় প্রকল্প শেষ না হওয়া-এসব চলছেই। বিনিয়োগ ২২ থেকে ২৩ শতাংশে আটকে আছে। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের উদ্যোগের কথা শুনেছি কত আগে। এর কোনো অগ্রগতি নেই। তৃতীয়টি হচ্ছে সামাজিক পুঁজি কাঠামোয় ধস। রাজনৈতিক কারণেই এমনটি হয়েছে। এক সময় আমাদের অন্যতম পুঁজি হিসেবে বিবেচিত ছিল সামাজিক পুঁজি। উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় এর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের জনগোষ্ঠী এখন সামাজিক কোনো উদ্যোগে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে না। রাজনৈতিক বিভক্তি, সংঘাত, সহিংসতা, দৃশ্যমান ও অদৃশ্য নানা ভয়ের কারণে মানুষ সতর্ক হয়ে গেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা পুলিশি হয়রানির ঝামেলা এড়াতে অনেকেই উদ্যোগহীন হয়ে পড়েছে। স্থানীয় সরকারব্যবস্থা সামাজিক পুঁজির অন্যতম বাহন হিসেবে কাজ করে।
দরিদ্র মানুষকে সহায়তার কিছু কর্মসূচি চালু আছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে শুধু দরিদ্ররা নয়, মধ্যবিত্তরাও চাপে পড়েছে। করোনার কারণে দারিদ্র্যের পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে ঠেকেছে, সেই পরিসংখ্যান নেই, কিন্তু টিসিবির ট্রাকের সামনের লাইন দেখে আমরা অনেক কিছুই বুঝতে পারি। এটা হচ্ছে দারিদ্র্যের দৃশ্যমান সূচক। দেশের গ্রামাঞ্চলে সাড়ে ৬২ লাখ গরিব পরিবারকে কম দামে চাল দেওয়া হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতে নগর দরিদ্রদের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। টিসিবির কার্যক্রম বাড়াতে হবে। এখানে দক্ষতার বিষয়টির দিকে নজর দিতে হবে। কারণ, সহায়তা দিতে চাইলেও কাকে দেওয়া হবে বা হবে না, তা ঠিক করা এক বড় সমস্যা। সঠিক তালিকা তৈরি করতে হবে। কাজটি দলীয়ভাবে করলে হবে না। অনেক এনজিও আছে, যাদের এসব কাজে দক্ষতা রয়েছে, তাদের কাজে লাগানো জরুরি। আরেকটি কাজ সরকার করতে পারে। বর্তমানে ৭৮ লাখ প্রাথমিক শিক্ষার্থীকে সরকার বৃত্তি দেয়। এই টাকা পরিবারের কাছে চলে যায় ব্যাংকিং-ব্যবস্থার মাধ্যমে। এর মানে প্রায় ৭৮ লাখ পরিবারের কাছে পৌঁছানোর মতো একটি ব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে। সেই বৃত্তির টাকা বাড়ানো হলে পরিবারগুলো উপকৃত হবে। অথবা সাময়িক পদক্ষেপ হিসেবে সেই পরিবারগুলোয় একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সহায়তার অর্থ পাঠানো যায়।
করোনার কারণে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কতটা বেড়েছে বা কত মানুষ দরিদ্র থেকে অতি দরিদ্র হয়েছে-এসব সংখ্যা ও তথ্য নিয়ে মতভেদ আছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সহায়তা করতে হলে বা তাদের জন্য বরাদ্দ রাখতে হলে তো যথাযথ তথ্য-উপাত্ত প্রয়োজন। তথ্যের ঘাটতি আছে-এটা সত্য। আবার যে তথ্য আছে, তার ওপর ভিত্তি করে সরকার কাজ করবে কি না, সেটাও একটি বিষয়। এখানে নিয়তটা বড় বিষয়। করোনার সময় দারিদ্র্যের পরিস্থিতি, সংখ্যা ও নতুন দারিদ্র্যের ধরন বোঝার জন্য আমরা নিজেদের মতো কাজ করেছি। আরও কেউ কেউ করেছে। সরকার তখন বলেছিল যে তারা একটি জরিপ করবে, কিন্তু দুই বছর পার হয়ে গেছে, তারা কিছু করেনি। আমাদের পরিসংখ্যান ব্যুরোর সক্ষমতা ও দক্ষতা অনেক বেড়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক কর্তৃত্বের অধীন তাদের চলতে হয়। সরকারের চাওয়ার সঙ্গে মিলিয়ে তাদের কাজ করতে হয়। কোনটা করবে বা কোনটা করবে না, সেই সিদ্ধান্ত সরকারের ওপর নির্ভর করে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে যে তথ্য সরকারের উন্নয়ন বয়ানের সঙ্গে মেলে না, তা নিয়ে সরকার অস্বস্তিতে ভোগে। আসলে তথ্য নিয়ে দ্বিধা থাকা উচিত নয়। আর তথ্যের জগৎকে দুর্নীতি থেকে মুক্তি দেওয়া জরুরি।
আর্থসামাজিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অর্থনীতির কাঠামোগত সমস্যা দেখা দিয়েছে। অর্থনীতিতে তিন লৌহ ত্রিভুজ গেড়ে বসেছে। ক্ষমতাসীন ও প্রভাবশালীরা একমাত্রিক উন্নয়নের দর্শন আটকে দিয়েছেন। স্বার্থের দ্বন্দ্বভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা তৈরি হয়েছে। আইনিভাবে অনিয়ম তৈরি করা হয়েছে।এসব অবিচারের খাটুনির বোঝা গরিব, স্বল্প ও সীমিত আয়ের মানুষের ওপর পড়ছে।
লেখক: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা