ভারতের গণতন্ত্র এবং বিজেপির শাসন
শুরু করেছিলেন মমতা ব্যানার্জি। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে প্রথম ক্ষমতায় এসে কংগ্রেস ও বামফ্রন্টের বিধায়কদের ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকায় কিনে নেন ও তার দল ভারী করেন। কেনার পদ্ধতি ছিল, স্থানীয় এসপি/ডিআইজিদের দিয়ে বিধায়কদের ডেকে তার কালীঘাটের বাড়িতে নিয়ে আসা হত। এই নাটকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তখনকার পশ্চিমবঙ্গের ডিরেক্টর জেনারেল অব পুলিশকে। মমতার এই কারসাজি ২০১৪ সালে দিল্লিতে এসে নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহরা অনুসরণ করতে শুরু করেন। প্রথম ধাক্কা তারা মারেন উত্তর পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্যে। রাজ্যগুলোতে কংগ্রেস জিতলেও সমস্ত বিধায়কদের তারা কিনে নেন।
১৮১৯ সালে ভারতের লোকসভা নির্বাচনে তারা সবাই কংগ্রেস দলের। প্রথমে তারা শুরু করে দক্ষিণের কর্ণাটক থেকে। কর্ণাটকে নির্বাচিত ১৯ জন কংগ্রেস প্রতিনিধিকে হাইজ্যাক করে চার্টারড ফ্লাইটে তুলে নিয়ে আসে মুম্বাইয়ে। তাদের সেখানে একটি পাঁচতারা হোটেলে ১৯ দিন রেখে দেওয়া হয়। কংগ্রেস থেকে এমন অভিযোগ করা হয়, ২৫ কোটি টাকা করে দিয়ে একেকজন নির্বাচিত বিধায়ককে কিনে নেওয়া হয়েছে।
কর্ণাটকের কংগ্রেস নেতারা মুম্বাইয়ে যে হোটেলে ছিলেন, সেখানে পৌঁছে যায় কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব। তারা এই বিধায়কদের ফিরিয়ে আনতে গিয়েছিলেন। মহারাষ্ট্রে তখন বিজেপির সরকার। আটক বিধায়কদের সঙ্গে কংগ্রেস নেতাদের মহারাষ্ট্রের পুলিশ দেখা করতে দেয়নি। বিজেপির সঙ্গে ওই বিধায়কদের লেনদেন শেষ হওয়ার পর তারা কর্ণাটকে ফিরে আসেন। ফিরে এসে তারা বিজেপিতে যোগ দেন। বিধান সভার আস্থা ভোটে কংগ্রেস হেরে যায় এবং বিজেপি সরকার গঠন করে।
এরপর হিন্দি বলয়ে মধ্যপ্রদেশ কংগ্রেস দুই বছর শাসন চালানোর পর ১৪/১৫ জন বিধায়ককে বিপুল অর্থের বিনিময়ে বিজেপিতে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়। এরপর তারা হাত দেয় রাজস্থানে। কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী বিদ্রোহী বিধায়কদের দিল্লির একটি পাঁচতারা হোটেলে দেখা করে ফিরিয়ে নিয়ে যান।
এই লেখার সময় দেখা গেল মোদি মন্ত্রিসভার এক মন্ত্রী টেলিভিশনে বলেছেন, আমরা রাজস্থান ও ছাত্তিমগড় শিগগিরই কিনে নেব। এই দুটি রাজ্যে কংগ্রেসের সরকার বলছে, এই হলো নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গণতন্ত্রের ভিন্ন রূপ। ভারতের বিশিষ্ট আইনজীবী এবং রাজনীতিবিদরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রতিদিন বলে যাচ্ছেন, ভারতের গণতন্ত্র এখন বিপন্ন। যে কোনো মুহূর্তে ভয়ংকর বিষ্ফোরণ ঘটতে পারে।
মোদি, অমিত শাহ ও তাদের দোসর মমতায় বিশ্বাস নেই। তারা এক নায়কতন্ত্রের বিশ্বাস করেন। সেই পথেই তারা এগুচ্ছেন। বিজেপি-আরএসএস এর একাধিক লক্ষ্যের মধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জেরে তারা তা করিয়ে নিয়েছে। তাদের দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হলো, হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করা। সারাদেশে বিশেষ করে হিন্দি বলয়ে সর্বত্র হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে নানা কায়দায় বিভেদ সৃষ্টি করে চলছে।
বিধায়ক এবং সাংসদ কেনার আগেই তারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে ভূরি ভূরি মিথ্যা দুর্নীতির অভিযোগ এনে তিনটি এজেন্সিকে কাজে লাগাচ্ছে। যেমন— সিবিআই, আয়কর বিভাগ এনফোর্সম্যান্ট ডাইরেক্টরেট। দল বদল করা হলেই তাদের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ কি করে যেন হাপিশ হয়ে যায়। যেমনটা পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে হয়েছে। একদা তৃণমূলের দুনম্বর নেতা মুকুল রায় এবং শুভেন্দু অধিকারীর ক্ষেত্রে। গত ১৫ দিনে মহারাষ্ট্রে কী ঘটেছে, একবার দেখা যাক।
মহারাষ্ট্রে জোট সরকার ছিল, বা এখনও আছে। শিবসেনা, এনডিপি এবং কংগ্রেসের। প্রায় আড়াই বছর আগে এই দুটি সরকার গঠিত হয়। তার নেতৃত্ব দেন মহারাষ্ট্রের স্ট্রংম্যান শারদ পাওয়ার।
বিদ্রোহী শিবসেনা বিধায়করা স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, হিন্দুত্ববাদ আসলে কি? খায় না মাথায় দেয়—তা তারা খুলে বলছেন না। সাধারণ মানুষের এখন পরিস্থিতি কি? সাধারণ মানুষ খেতে পরতে পারছেন না। প্রবল বন্যায় আসাম ও ত্রিপুরা বিপর্যস্ত হয়ে রয়েছে। শহরের পর শহর এখনও জলের তলায়। শিলচর, হাইলাকান্দির মতো শহর পুরোটাই একতলা বাড়ির সমান জল। সরকারি হিসেবেই এখনো পর্যন্ত প্রায় ২০০ মানুষ মারা গেছেন প্রবল বন্যায়। অনেক জায়গায় শ্মশান এবং কবরস্থানও জলের নিচে চলে যাওয়ায় মরদেহের সৎকার পর্যন্ত করা সম্ভব হচ্ছে না।
লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক
আরএ/