শিক্ষার্থীদের সুনাগরিক হিসেবে গড়তে পারিনি
সাম্প্রতিককালে আমরা দেখতে পাচ্ছি, শিক্ষকদের উপর আক্রমণ আসছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্নভাবে আক্রমণগুলো হচ্ছে। আমরা দেখতে পেলাম নড়াইলে একজন শিক্ষককে গলায় জুতা পরিয়ে হাত জোর করা অবস্থায় তার কক্ষ থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেখানে প্রশাসনের মানুষ, বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ, ছাত্র-শিক্ষকরা তো রয়েছেই, এই দৃশ্য দেখলে শিক্ষক হিসেবে অপমানিত বোধ করছি শুধু না, একজন মানুষ হিসেবেও লজ্জিতবোধ করছি। তারপর আশুলিয়াতে দেখা গেল, কতিপয় শিক্ষার্থী ক্রিকেট খেলার ব্যাট দিয়ে পিটিয়ে একজন শিক্ষককে হত্যা করেছে। তার আগেও আমরা দেখেছি, একজন শিক্ষককে কান ধরে উঠাবসা করা হচ্ছে। কিন্তু কেন এই ঘটনাগুলো ঘটছে? তার ভেতরে যাওয়াটা বোধ হয় খুব জরুরি হয়ে উঠেছে।
শিক্ষার্থীদের সঠিক শিক্ষা দেওয়া যাচ্ছে না বলে আমি মনে করি। একইসঙ্গে শিক্ষা প্রশাসনে যারা জড়িত আছে, তাদেরও কর্ম তৎপরতার অভাব আছে। ঘটনাগুলো ঘটে যাওয়ার পরে যে তৎপরতা, অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিদানের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অবহেলা দেখা যায়। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো যদি আমরা পর্যালোচনা করি, তাহলে বোঝা যায়, এই শিক্ষার্থীদের আমরা সঠিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারিনি। মানুষ হিসেবে যদি আমরা একজন শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলতে না পারি, তাকে জিপিএ ৫দিয়ে যদি সফল মানুষ করে গড়ে তোলার যে অভিপ্রায় সেটি কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাজে লাগে না। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, অভিভাবকরা সব চায় তার সন্তান জিপিএ ৫ পাক। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো চায় শিক্ষার্থীরা জিপিএ ৫ পাক। এই সংখ্যাটি তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এটি দিয়ে তারা তাদের সফলতা নির্ণয় করতে চায়। অভিভাবকরা দেখাতে চান তাদের সন্তানরা জিপিএ ৫ পাওয়া। জিপিএ ৫ হয়ে গেছে এখন সাফল্যের তারকা। অর্থাৎ সাফল্য বলতে জিপিএ ৫। এই জিনিসগুলো আগে ছিল না।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেছিলেন, সেটি ছিল প্রকৃত মানুষ গড়ার শিক্ষা। তিনি প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করলেন। প্রথম থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক একইসঙ্গে অবৈতনিক করলেন। যাতে করে প্রজাতন্ত্রের কোনো শিক্ষার্থী প্রাথমিকশিক্ষা থেকে বঞ্চিত না হয়। একইসঙ্গে এটিকে একমুখী করলেন এজন্য যে, আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা আছে, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য একটি দেশ প্রতিষ্ঠা করা যার মূল ভিত্তি হবে— সাম্য মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায় বিচার। সাম্যবাদ সৃষ্টি করতে হলে, প্রজাতন্ত্রের সব শিশুর মধ্যে সমতাবোধ সৃষ্টি করতে হবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরে বঙ্গবন্ধুর যে শিক্ষানীতি সেটি বাস্তবায়ন করা গেল না এবং ১৯৭৫ থেকে ২০১০ অব্ধি এই শিক্ষানীতি ছাড়া শিক্ষা কার্যক্রম এগিয়ে গেছে।
আমি মনে করি, একটি দেশের শিক্ষা হচ্ছে সেই দেশের চোখ। মানুষের চোখ থাকে এবং সে যে কারণে এগিয়ে যায়, একটি দেশও সুশিক্ষার মধ্য দিয়েই এগিয়ে যায়।২০১০ সালে এসে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা যে শিক্ষানীতি দিয়েছেন, সেই শিক্ষনীতি আমরা বাস্তবায়ন করে চলেছি। মাঝখানে অনেকটা সময় চলে গেছে এবং সেসময় অনেক শিক্ষার্থীও বেরিয়ে গেছে। তাদের অধিকাংশই বিভিন্ন পেশায় এমনকি শিক্ষাকতা পেশায় আছে। একটি উদাহরণ দিয়ে যদি বলি, বুয়েটের মেধাবি ছাত্র আবরার তার মতোই মেধাবি সহপাঠীদের দ্বারা হত্যার স্বীকার হয়েছে। অনেক শিক্ষকও সেখানে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল বলতে হবে। এখন শিক্ষার্থী ও শিক্ষক হত্যা এই ছাত্রছাত্রীরাই করছে।
এখন সমস্যা হচ্ছে আমরা সত্যিকারের মানুষ গড়ার জন্য যে শিক্ষাটি দরকার সেই শিক্ষাটি দিতে পারছি না। শিক্ষার্থীদের মধ্যে যদি মানবতাবোধ তৈরি করতে না পারি, তাহলে এটি একটি ব্যাধিতে পরিণত হবে। শিক্ষার্থীরা আজকে নিজের শিক্ষার্থী বন্ধুকে, নিজের শিক্ষককে মারছে, কাল তার পিতা মাতাকে মারবে। আমরা পত্রিকার পাতা খুললে এসবই দেখতে পাচ্ছি। যেটি দিনে দিনে একটি মারাত্মক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে । সুতরাং আমার মনে হয় আমাদের শিক্ষানীতির একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন দরকার হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া উত্তরণের কোনো পথ আমাদের জানা নেই।
লেখক: সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আরএ