আত্মমর্যাদা, সক্ষমতা ও সাহসের প্রতীক পদ্মা সেতু
পদ্মা নিয়ে অনেক গান, গীতিনাট্য, কবিতা, গল্প, উপন্যাস রচিত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের ভান্ডারের পদ্মার অনেক অবদান। পদ্মা কখনো শান্ত আবার কখনো অশান্ত। অশান্ত পদ্মাকে শাসন করে কে? সে নিজেই যেন নিজের নিয়ন্ত্রক। পদ্মা কখনো জীবন ও জীবিকার ওপর চরম আঘাত হেনেছে। আবার কখনো পদ্মা মানুষের ভাগ্য বদলে দিয়েছে।
আবু ইসহাকের বিখ্যাত উপন্যাস পদ্মার পলিদ্বীপ যারা পড়েছেন তাদের কারো কাছে পদ্মা একটি আবেগের নাম, একটি ভালোবাসার নাম। আবার কারো কাছে চরদখল, চরের ধান লুটপাট আর জোতদারকে নিপিড়ন নির্যাতনের নাম। যেভাবেই আমরা দেখি, পদ্মা বাঙালির জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
পদ্মা নিয়ে কবি কাজী নজরুল ইসলামের সেই কালজয়ী গান ‘পদ্মার ঢেউ রে, মোর শূণ্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা, যা রে’। আজো আমাদের কানে বাজে। কানে বাজে ফরিদা ইয়াসমিনের গাওয়া ‘এই পদ্মা এই মেঘনা এই যমুনা সুরমা নদী তটে’ গানটি। পদ্মা নিয়ে অনেক কাহিনিও আমাদের লোক সমাজে প্রচলিত আছে। পদ্মার তলদেশে আরেক প্রবাহমান নদী রয়েছে। যে কারণে সেতুর পাইলিং করতে গিয়ে মহাসংকটে পড়েছিলেন সেতু বিশেষজ্ঞরা। শুধু কি তাই? নদী শাসন করতে গিয়েও তাদেরকে অনেক বেগ পেতে হয়েছিল।
সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে সংশ্লিষ্টরা টের পেয়েছিলেন পদ্মা সত্যিই এক প্রমত্তা নদী। পদ্মার মতো স্রোতসিনি নদী খুব কমই আছে এদেশে। সাগরের মতো পদ্মার উঁচু উঁচু ঢেউ কারো বুক ভাঙে। আবার কারো ভাঙে ঘর। এর গতিপ্রকৃতি বোঝা বড় কঠিন। পদ্মার বুকে সেতু হবে এ ছিল আমাদের কাছে কল্পনাতীত ব্যাপার। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্যকন্যা শেখ হাসিনা। তিনি দৃঢ়প্রত্যয়ী না হলে পদ্মা সেতু করা কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। সেতু করতে গিয়ে তাঁকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। অনেক ঝক্কি-ঝামেলা সহ্য করতে হয়েছে। বড় বড় ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে হয়েছে।
শুরুতে কিছু গণমাধ্যমও পদ্মা সেতু প্রকল্পকে আকাশকুসুম কল্পনা বলে মন্তব্য করেছে। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল নানা রকম নেতিবাচক মন্তব্য করেছে। বিশ্বব্যাংক সেতুর জন্য অর্থ বরাদ্দের আগেই দুর্নীতির অভিযোগ এনেছিল তখনকার যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে। এ অভিযোগে তাকে মন্ত্রিসভা থেকে তখন বাদ দেওয়া হয়। শাস্তি ভোগ করতে হয় তখনকার যোগাযোগ সচিবকেও। তবু হাল ছাড়েননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পদ্মা সেতু নির্মাণের ব্যাপারে তিনি অনড়। তিনি তাঁর সব ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন।
এ প্রসঙ্গে একটা কথা না বললেই নয়। আমি তখন কালের কণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে পত্রিকাটি দেখভাল করছি। প্লানিং টিমের এক বৈঠকে পদ্মা সেতু নিজস্য অর্থায়নে সম্ভব কি না সে সব বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। আলোচনার এক পর্যায়ে উপ-সম্পাদক ও রিপোর্টিং টিমের প্রধান টিটু গুপ্ত বললেন, নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু করা সম্ভব। এর সপক্ষে তিনি নানা যুক্তি, তথ্য ও বিশ্লেষণ তুলে ধরলেন। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, এটা নিয়ে ক্যাম্পেইন শুরু করব। শুরুতেই প্রধান শিরোনাম করলাম, নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু করা সম্ভব। শুরু হলো আমাদের ক্যাম্পেইন। একের পর এক রিপোর্ট ছাপা হচ্ছে। নিজস্ব অর্থায়নের পদ্মা সেতু করার পক্ষে জনমত তৈরি হচ্ছে। আরেকদিকে কিছু পত্রিকা ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা নেতিবাচক প্রপাগান্ডা চালাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করলেন, নিজস্ব অর্থায়নের হবে পদ্মা সেতু। সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ বলে উঠলেন, এই না হলে শেখের বেটি!
দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ার, বয়স এবং রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার গুণে শেখ হাসিনা এশিয়ার অনন্য রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তার সঙ্গে এশিয়া অঞ্চলের বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বিশেষ করে চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিন পিন, রাশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান পুতিন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেদ্র মোদির কাছে শেখ হাসিনার গ্রহণযোগ্যতা ও গুরুত্ব অনেক বেশি। সেই সম্পর্কের সূত্র ধরেই তিনি দেশের স্বার্থে অনেক কাজ করতে পারছেন। পদ্মা সেতু নির্মাণে চীনের সবচেয়ে বড় ভ‚মিকা রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ের সুসম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ। চীনের সহযোগিতা ছাড়া এই সেতু কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। এজন্য চীনের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই।
করোনা মহামারির মধ্যেও পদ্মা সেতুর কাজ একদিনের জন্যও বন্ধ ছিল না। পদ্মা সেতুর বিশাল বিশাল স্ল্যাব চীন থেকে তৈরি করে জাহাজে সেতুস্থলে নিয়ে আসা হয়। চীনের অসংখ্য সেতু বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী ও কর্মী রাতদিন সেতুর কাজে নিয়োজিত ছিলেন। তাদের এবং বাংলাদেশীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবে রূপ লাভ করে। পদ্মা সেতু এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায়। সমগ্র জাতি তাকিয়ে আছে উদ্বোধনের সেই মাহেন্দ্রক্ষণের দিকে।
পদ্মা সেতু কেবল গাড়ি চলাচলের একটি সেতুই নয়। এই সেতু উন্নয়নের প্রতীক। বাঙালির সক্ষমতার এক অনন্য দলিল। বাঙালির আত্মমর্যাদা এবং সাহস অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে পদ্মা সেতু। বাঙালি স্বপ্ন দেখলে সেই স্বপ্ন কিভাবে বাস্তবায়ন করতে হয় তাও তারা জানে। আর এই বাঙালিকে দাবিয়ে রাখা যাবে না। বঙ্গবন্ধু একাত্তরের সাতই মার্চের ভাষণেই বলে দিয়েছিলেন, বাঙালিকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। সত্যিই আজ তা প্রমাণিত হলো। বাঙালিকে দাবিয়ে রাখা যায় না।
বাঙালির অহংকারের প্রতীক পদ্মা সেতু উপহার দেওয়ার জন্য দেশের জনগণের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই। জয়তু শেখ হাসিনা, জয়তু বাংলাদেশ।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, ঢাকাপ্রকাশ ও সাহিত্যিক।