শ্রীলঙ্কার লোকসংস্কৃতি ও বাঙালি
যে কোনো ভাষার লোকসঙ্গীত বা লোককাহিনির মধ্যে একটি দেশের নির্দিষ্ট জাতির বা জনগোষ্ঠীর প্রাচীন ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক স্মৃতির কথা জনমানসে চিরস্থায়ীভাবে জায়গা করে নেয়। শৈশবের স্মৃতিজুড়ে থাকে গ্রামে-গঞ্জে প্রচলিত বা প্রবীণদের মুখ থেকে শোনা অনেক লোকগান, যেগুলো রোমন্থনে মিশে থাকে গভীর আবেগ এবং নস্টালজিয়া। তবে অবাক হতে হয় যখন এক দেশের লোকগানে অন্য দেশের কথা উল্লেখ থাকে।
আমি শ্রীলঙ্কায় অধ্যয়ন করার সময় সে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে থাকা ও ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ হয়েছিল। নিজের বাংলাদেশি পরিচয় দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শ্রীলঙ্কার অনেকেই, বিশেষ করে প্রবীণরা আমায় কিছু লোকজ গীতির কথা বলতেন, যেখানে বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। শ্রীলঙ্কার এমন বেশকিছু লোকগান এবং লোককাহিনী জুড়ে যে বাঙালির উল্লেখ রয়েছে তা অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক। সেগুলো নিয়ে এখনো কোনো গভীর গবেষণা হয়েছে বলে জানা নেই। এ লেখায় স্মৃতি থেকে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হবে।
শ্রীলঙ্কায় প্রচলিত বিভিন্ন ধরনের লোকগানগুলোকে সামগ্রিকভাবে ‘জন-কাবি’ বা ‘জন-গায়ন’ অর্থাৎ লোকজ কবিতা বা লোকজ গান বলা হয়। তেমন একটি গানের নাম হচ্ছে ‘অলিন্দা কাবি’ (olinda kavi)। এর বিষয় হচ্ছে ‘অলিন্দা’ যেটি বাংলায় রত্তি, কইচ গোটা, কুঁচ, প্রভৃতি নামে পরিচিত। এই গানের প্রথম স্তবকের কথা বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায়–
-অলিন্দা (বা রত্তি) কোন্ দেশে আছে? (অলিন্দা তিবেন্নে কয়ি কয়ি দেসে?)
-অলিন্দা আছে বাংলাদেশে (অলিন্দা তিবেন্নে বাঙালি দেসে?)
-সেখান থেকে এনে কোন দেশে চাষ করা হয়? (গেনাত হাদান্নে কয়ি কয়ি দেসে?)
-সেখান থেকে এনে চাষ করা হয় সিংহলী দেশে (গেনাত হাদান্নে সিংহলী দেসে?)
এই গানের মূল রচয়িতা কে সেটা জানা যায় না। তবে সিংহলী ভাষার লোকজ গানের সমৃদ্ধ সম্ভারের মধ্যে এটি অত্যন্ত প্রসিদ্ধ। উপরের উদ্ধৃতিতে দেখা যায়, এর প্রথম স্তবকটি প্রশ্ন-উত্তরের আনুক্রমিক ধারায় সাজানো হয়েছে। শ্রীলঙ্কার নতুন বছরে আয়োজিত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এখনো এই গানের সাথে নৃত্য-পরিবেশন করে উপস্থাপন করা হয় (আগ্রহীরা olinda kavi লিখে ইউটিউবে দেখতে পারেন)। বিশেষ করে প্রাথমিক বা উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই এটি পরিবেশন করে থাকে। এ ছাড়াও গ্রামের বাচ্চারা রত্তির বিচি নিয়ে গুটি খেলার সময় নাকি এই গানটি গেয়ে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে–এই রত্তি কীভাবে বাংলাদেশ থেকে শ্রীলঙ্কায় নেওয়া হলো? শ্রীলঙ্কার লোকসঙ্গীতে এটি কীভাবে জায়গা করে নিল? এর দ্বারা কি বৃহত্তর বঙ্গ এবং শ্রীলঙ্কার মধ্যে প্রাচীন কোনো ব্যবসায়িক সম্পর্কের কথা বলা হচ্ছে, যেটি অন্য কোনো ইতিহাস গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হয়নি?
এই প্রশ্নগুলোর সরাসরি জবাব দেওয়া হয়তো এখন অনেকটা দুরুহ বা বিস্তারিত গবেষণা সাপেক্ষ। তবে এটা বলা যায়–দক্ষিণ এশিয়ার সংস্কৃতিজুড়ে রত্তির ব্যাপকভাবে ব্যাবহার রয়েছে। আমরা জানি, আমাদের পূর্বজরা স্বর্ণাদি মাপার জন্যে রত্তি ব্যবহার করতেন। পক্ষাঘাত জাতীয় রোগের জন্য আয়ুর্বেদিক ঔষধ হিসেবেও নাকি রত্তির প্রচলন রয়েছে। প্রসঙ্গত, সিংহলী ভাষার এই গান ছাড়াও রাজস্থানের একটি লোকগানের বিষয় হচ্ছে–বিয়ের পর মেয়ে রত্তির গাছে (রাজস্থানি ভাষায় ‘ছিরমি’) উঠে দেখছে তার বাবা এবং ভাই কবে তাকে দেখতে আসবে। সুতরাং রত্তি যে উপমহাদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং প্রয়োজনীয় জিনিস, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তাই বোধ হয় শ্রীলঙ্কার অজ্ঞাতনামা এক কবিও তার দেশে রত্তি নিয়ে আসার জন্য প্রাচীন বণিকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে অলিন্দা-কাবি রচনা করে বাঙালিদের চিরকালের জন্য গর্বিত করে রেখেছেন।
রত্তির মতো অন্য একটি প্রসিদ্ধ গানের বিষয় হচ্ছে বাঙালি হাতের বালা বা চুড়ি (বাঙালি-ওয়ালালু)। এই গানের লেখক প্রেমাকীর্তি দী আল্উইস। এটি তুলনামূলক আধুনিক হলেও লোকজ গানের ধাঁচেই পরিবেশন করা হয়। এই গানের প্রেক্ষাপট হচ্ছে স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কিছু আবদার। বিদেশগামী স্বামীকে স্ত্রী বলছে (ভাবার্থ)–
–প্রতিজ্ঞা করো বাঙালি হাতের চুড়ি নিয়ে আসবে, (বাঙালি ওয়ালালু গেনা এন্নাই পরন্দুয়া)
–প্রতিজ্ঞা করো সিল্কের শাড়ি নিয়ে আসবে, (দুহুলেল সারি গেনা এন্নাই পরন্দুয়া)
–প্রতিজ্ঞা করো স্বর্ণের গলার হার নিয়ে আসবে, (রান্মিনি মালা পালান্দান্নাই পরন্দুয়া)
–এগুলো একসঙ্গে করার পর জাহাজে জায়গা আছে কি না দেখবে। (এয়া ইটু কেরেনা কালা নাওয়াদা ইতিন তাওয়া...)
এই গানের মধ্যেও ব্যবসায়িক প্রসঙ্গটা পরিষ্কার। এই গানটিতে শ্রীলঙ্কায় বাঙালি হাতের বালা যে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত, তা স্পষ্ট।
আমার মনে আছে, একবার ২০০৮ সালের দিকে শ্রীলঙ্কায় এক বন্ধুর বাসায় থেকেছিলাম বেশকিছু দিন। তার একটি নিজস্ব পুরনো সাদা-কালো টেলিভিশন ছিল, যেটি সে নিজেই কোথাও থেকে জোগাড় করে মেরামত করে বইয়ের শেলফে লুকিয়ে রাখে এবং গোপনেই দেখে। কারণ তার নিজস্ব টিভি রাখার অনুমতি ছিল না। সে যা-ই হোক, একদিন টিভিতে একটি নাটক চলাকালীন হঠাৎ শুনলাম নাটকের এক চরিত্র বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করছে। আমার বন্ধুকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, তারা বাংলাদেশের ঢাকাই শাড়ির কথা বলছে। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, শ্রীলঙ্কায় বাংলাদেশের শাড়িরও কিছুটা কদর রয়েছে।
শ্রীলঙ্কার লোকসংস্কৃতিতে বাংলাদেশের নাম সবচেয়ে বেশি সম্পৃক্ত হচ্ছে সিংহলী জাতির উৎপত্তির কাহিনিতে, যেখানে প্রাচীন বঙ্গের একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে। বিশেষ করে প্রাচীন বঙ্গ রাজ্যকে শ্রীলঙ্কার সর্বপ্রথম রাজা এবং আর্য সভ্যতার প্রতিষ্ঠাতা বিজয় রাজকুমারের পিতৃভূমি হিসেবে গণ্য করা হয়। পালি ভাষায় রচিত প্রায় দেড় হাজার বছরেরও পুরাতন শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রীয় ইতিহাস গ্রন্থ ‘মহাবংশ’-তে এই উপাখ্যান বিশদভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে।
সংক্ষেপে এই কাহিনির পটভূমি হলো–প্রায় আড়াই হাজার বছরেরও বেশি সময় পূর্বে বিজয় রাজকুমারের পিতামহ ছিলেন বঙ্গের রাজা। তিনি প্রাচীন কলিঙ্গ (তথা বর্তমান উড়িষ্যা) রাজ্যের এক রাজকুমারীকে বিয়ে করেন। তার মেয়ে রাজকীয় অতিরঞ্জিত জীবনের বাইরে স্বাধীনভাবে বাঁচার জন্য রাজপ্রাসাদ থেকে পালিয়ে যান। তাকে সিংহ নামের এক দস্যু (মতান্তরে সিংহ আসলেই প্রাণী ছিল) বন্দি করে জোরপূর্বক বিবাহ করে। সিংহের এক গুহায় বন্দি অবস্থাতেই রাজকুমারী একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে সন্তানের জন্ম দেন। ছেলের নাম করা হয় সিংহবাহু (পালিতে সীহবাহু) এবং মেয়ের নাম করা হয় সিংহশীবলী (পালিতে সীহসীবলি)। তারা পূর্ণবয়স্ক হওয়ার পর তাদের মা নিজের অতীতের কথা তাদেরকে বলেন।
এরপর সিংহবাহু তার মা এবং বোনকে সিংহের গুহা থেকে মুক্ত করে বঙ্গরাজ্যে নিয়ে আসেন। পরবর্তীকালে সিংহবাহু এবং সিংহশীবলী না কি তৎকালীন সমাজের রীতি ও নিয়ম অনুসারে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদেরই সন্তান রাজকুমার বিজয়।
রাজকুমার বিজয় তেমন ভালো স্বভাবের ছিলেন বলা যাবে না। তার বন্ধুদের নিয়ে সে ঘুরে বেড়াত এবং যেখানে সেখানে বিশৃঙ্খল আচরণ করত। রাজ্যের মানুষ, বিশেষ করে রমণীরা তার দলের কাছে হয়রানির শিকার হয় বারবার এবং অনন্যোপায় হয়ে তারা রাজাকে নালিশ করতে থাকেন। ন্যায়নিষ্ঠ রাজা গত্যন্তর না দেখে বিজয় এবং তার দলকে নির্বাসিত করেন রাজ্য থেকে। নির্বাসন প্রাপ্ত রাজকুমার ও তার সঙ্গীরা জাহাজে ভারত সমুদ্রে যাওয়ার পথে লঙ্কা দ্বীপ আবিষ্কার করে। অনেকটা ক্রিস্টোফার কলম্বাসের এমেরিকা আবিষ্কারের মতোই! দূর থেকে দ্বীপের বালির রং দেখতে তাম্রবর্ণের ছিল বলে তারা এই দ্বীপটিকে তাম্রপর্ণী নামকরণ করেন। এটাই শ্রীলঙ্কার প্রাচীন নাম। প্রাচীন গ্রিক ঐতিহাসিকেরাও শ্রীলঙ্কাকে ‘তাপ্র-বেন’ নামে চিহ্নিত করেছেন।
তখনও পর্যন্ত শ্রীলঙ্কায় যক্ষ জনগোষ্ঠীই মূলত বসবাস করতেন বলে ধারণা করা হয়। যক্ষদের কুবেণী নামের একজন মেয়ের সাথে রাজকুমার বিজয়ের সম্পর্কও হয়েছিল। অনেকেই মনে করেন যে বর্তমানের বেদ্দা সম্প্রদায়ের লোক সেই প্রাচীন যক্ষদের বংশধর। বিজয় অবশ্যই পরবর্তীতে কুবেণীকে ত্যাগ করেন এবং কলিঙ্গ রাজ্য থেকে অন্য রাজকুমারীকে বিয়ে করেন।
এই কাহিনি শতভাগ সত্যতা নিশ্চিত করা এখন দুরূহ। তখনকার বঙ্গরাজ্য বর্তমানের কোন অঞ্চলে অবস্থিত সে বিষয়েও মতান্তর রয়েছে। তবে শ্রীলঙ্কার মানুষেরা এখনো দৃঢ় বিশ্বাস করেন যে, বিজয় এবং তার সঙ্গীরাই সিংহলী জাতির আদি পুরুষ। বিভিন্ন সময় শ্রীলঙ্কার কূটনীতিকরাও বাংলাদেশ ভ্রমণে এসে এই কাহিনির উল্লেখ করে এবং বাঙালি ও সিংহলি মানুষের গভীর ঐতিহাসিক সম্পর্কের কথাও ব্যক্ত করেছেন। রাজকুমার বিজয়ের লঙ্কা বিজয় নিয়ে শ্রীলঙ্কায় যুগে যুগে অনেক কাব্য, গল্প, মঞ্চ নাটক, এবং সিনেমা তৈরি হয়েছে। তার সঙ্গে উজ্জ্বল হয়ে আছে প্রাচীন বঙ্গের নাম, যেটি আধুনিক বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতিকে আনন্দিত ও গর্বিত করে। এই কাহিনি এবং উপরে আলোচিত লোকগানগুলো দুদেশের মানুষের মধ্যে অকৃত্রিম বন্ধুত্ব স্থাপনের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।
লেখক: পিএইচডি গবেষক, এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র
এসএ/