ঠাকুরগাঁওয়ে ২১ কোটি টাকার পেঁয়াজ বীজ উৎপাদনের সম্ভাবনা
পেঁয়াজের ঘাটতি ও চাহিদা পূরণে এর বীজ উৎপাদনের জন্য ৩২ বিঘা জমিতে পেঁয়াজ চাষ করেছেন ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার চাড়োল গ্রামের যুবক কৃষি উদ্যোক্তা মো. মোয়াজ্জেম হোসেন।
পর্যাপ্ত পরিমাণে মৌমাছি না থাকায় বীজ উৎপাদনে মানুষের হাতের ছোঁয়ায় করছেন পরাগায়ন। এতে স্থানীয়দের যেমন আয়ের সুযোগ হয়েছে তেমনি এই বীজ দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখার পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবেন বলে আশা করছেন এই উদ্যোক্তা।
জেলা শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার চাড়োল গ্রামে মোয়াজ্জেম হোসেনের মতো আরও অনেক কৃষক শত শত বিঘা জমিতে পেঁয়াজের বীজ উৎপাদনে চাষ করেছেন। এলাকার ফসলি মাঠগুলোর দিকে তাকালে চোখে পড়ে শুধু পেঁয়াজ গাছের সবুজ ডাঠা ও কদম ফুলের আকৃতির মতো সবুজ সাদা শুভ্র ফুল আর ফুল। চোখ ও মন জুড়ানো সবুজ ও সাদা ফুল থেকে এক-দুটো মৌমাছির মধু আহরণ প্রকৃতিতে এনে দিয়েছে এক অনন্য মনোরম দৃশ্য।
দেখা যায়, সকাল হলেই এসব বীজ খেতের পরিচর্যায় কেউ সেচ, কেউ আবার পোকা দমনে কীটনাশক স্প্রে ও কেউ হাতের আলতো ছোঁয়ায় পরাগায়ন করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। এতে এলাকার শত শত নারী-পুরুষ ও পড়াশোনার পাশাপাশি অনেক কিশোর-কিশোরীরাও এসব কাজ করছেন। শুধু মোয়াজ্জেমের বীজ উৎপাদন খামারেই প্রতিদিন কাজ করে অন্তত ৮০ জন মানুষ।
কাজ করতে আসা খায়রুল আলম, আবু সায়েমসহ স্থানীয়রা বলেন, তেমন মৌমাছি না থাকায় ও ভালো বীজ উৎপাদনের জন্য মোয়াজ্জেমের পেঁয়াজ খেতে সকাল ১১টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত পরাগায়ন করতে প্রতিদিন ৭০-৮০ জন কাজ করি। এতে করে আমাদের ভালো আয় হয় এবং এই আয়ে সংসার ভালোই চলছে।
কাজ করতে আসা একাদশ শ্রেণির সুমন আলী নামে এক কলেজছাত্র বলেন, আমার মতো এখানে অনেক স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ করি। কাজ করে যা আয় করি তাতে আমাদের পড়াশোর খরচ অনেকটা এগিয়ে যায়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম জানান, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার জেলায় ব্যাপক পরিসরে পেঁয়াজ বীজ উৎপাদন হচ্ছে। জেলার ৫ উপজেলার মধ্যে ৪ উপজেলায় এবার পেঁয়াজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৭৯৮ হেক্টর নির্ধারণ করা হলেও আবাদ হয়েছে ৮০৬ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে এ পর্যন্ত ১৬০ হেক্টর জমির ফসল কাটা হয়েছে। এ ছাড়া ১১৩ হেক্টর জমিতে শুধু পেঁয়াজ বীজ উৎপাদন হচ্ছে। প্রতি হেক্টর জমিতে ৯০০ কেজি করে মোট ১০২ মেট্রিক টন বীজ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। আর প্রতি কেজি বীজের দাম ২ হাজার করে ধরা হলে শুধু ঠাকুরগাঁও জেলায় ২০ কোটি ৩৪ লাখ টাকার পেঁয়াজ বীজ উৎপাদন হবে বলে জানান তিনি।
আগে স্বল্প পরিসরে বীজ উৎপাদন করলেও এবার পেঁয়াজের চাহিদা ব্যাপক হওয়ায় এবং দেশের পেঁয়াজ চাষিদের কাছে ভালো বীজ পৌঁছানোর উদ্দেশেই বেশি করে বীজ উৎপাদন করছেন। যাতে করে চাষিরা ভালো বীজ পান ও বেশি করে পেঁয়াজ উৎপাদন করতে পারেন। তার ৩২ বিঘা জমিতে পেঁয়াজের বীজ উৎপাদন করতে প্রায় ৩০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। পেঁয়াজের ফুল ও পরাগায়ন ভালো হওয়ায় ৩২ বিঘা জমি থেকে উৎপাদিত বীজ কমপক্ষে ৪০ লাখ টাকায় বিক্রি হবে বলে আশা করছেন মোয়াজ্জেম হোসেন।
তিনি আরও বলেন, পেঁয়াজ রোপণের মাত্র ৪ মাসের মধ্যে গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করা যায়। আর গাছে ফুল আসার পর থেকে টানা ৩০ দিন সকাল ১১টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত হাতের ছোঁয়ায় পরাগায়ন করতে হয়। তাহলে ভালো বীজ ও ফলন পাওয়া যায়। সরকার যদি আমাদের স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করে দেন আমি ও আমার মতো আরও অন্যান্য কৃষকরাও ব্যাপক পরিসরে পেঁয়াজ চাষ করতে পারতাম।
সাধুবাদ জানিয়ে মোয়াজ্জেমের এমন উদ্যোগে দেশে কিছুটা হলেও পেঁয়াজের ঘাটতি পূরণ হবে বলে মনে করছেন স্থানীয় স্বপন আলীসহ অনেকে।
সরকারিভাবে মসলা জাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বেশকিছু কর্মসূচির মাধ্যমে কৃষি বিভাগ কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছে বলেই এবার ঠাকুরগাঁওয়ে মোয়াজ্জেম ও মাসুদ রানার মতো অনেকেই পেঁয়াজ বীজ উৎপাদন করেছেন বলে জানান জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম।
তিনি ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, এভাবে পেঁয়াজ বীজ উৎপাদনে অনেক শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। এ ছাড়া কৃষকদের বীজ উৎপাদনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে অদূর ভবিষ্যতে এই মশলা জাতীয় ফসলের উৎপাদন এ জেলায় আরও বৃদ্ধি করা হবে এবং এর সঙ্গে মৌ-চাষকে সম্পৃক্ত করলে কৃষকরা আরও বেশি লাভবান হবেন বলে মনে করেন তিনি।
এসজি