হলুদ ফুলে লুকানো কৃষকের স্বপ্ন
নীলফামারীতে ফসলের মাঠজুড়ে এখন শুধুই হলুদের সমারোহ। সরিষা ফুলের মৌ মৌ গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে বাতাসে। ভোজ্য তেলের মূল্য বৃদ্ধি ও সরিষা তেল স্বাস্থ্য সম্মত হওয়ার কারণে গত কয়েক বছরের চেয়ে জেলায় এবার সরিষার আবাদ কয়েক গুণ বেড়েছে।
লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ জমিতে হয়েছে সরিষার আবাদ। ফলনও হয়েছে ভালো। আর কয়েকদিন পরেই চাষিরা সরিষা ঘরে তুলতে ব্যস্ত সময় পার করবেন। সরিষা তোলার পরই কেউ ভুট্টা আবার কেউ বোরো আবাদে নেমে পড়বেন। সে কারণে কৃষকরা মাঠ উপযোগী করতে কাজ করে যাচ্ছেন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় বাম্পার ফলনের আশা করছে কৃষি বিভাগ ও কৃষকরা।
জেলা কৃষি বিভাগ জানিয়েছেন, জমি থেকে সরিষা উঠার পর বোরোর আবাদে মেতে উঠবে কৃষক। মাঝের সময় সরিষা আবাদ করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবেন তারা। সরিষা আবাদের ফলে কৃষি জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পায় ও বোরোর ফলন ভালো হয়। এ বছর অধিক (উচ্চ) ফলনশীল আগাম জাতের সরিষার চাষ করছেন চাষিরা। এর মধ্যে বারি-১৪, ১৫, ১৬, ১৭, ১৮ জাত চাষে কৃষক মাত্র ৭৫ থেকে ৮০ দিনের মধ্যে ফসল ঘরে তুলতে পারবেন। প্রতি হেক্টরে ফলন হয় দেড় হাজার কেজি (প্রায় সাড়ে ৩৭ মণ)। তবে স্থানীয় জাত টরি-৭ ফলন কম হয়, উৎপাদনের সময়ও বেশি লাগে। এ জন্য চাষ কমিয়ে দিয়েছেন অনেকে। বারি জাত ছাড়াও বিনা-৪, ৯ ও ১৭ জাতের সরিষার ফলন ভালো হয়।
তা ছাড়া বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উচ্চ ফলনশীল জাতের সরিষা বীজ উদ্ভাবন করায় বর্তমানে চাষের পরিমাণ বেড়েছে। এর মধ্যে বারি-১৪, ১৫, বিনা-৯/১৭, ৪ ও সোনালি সরিষা (এসএস-৭৫) উল্লেখযোগ্য। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫ হাজার ৫৫০ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও চাষ হয়েছে প্রায় ৭ হাজার হেক্টরেরও বেশি। এর মধ্যে সদরে দুই হাজার ৫৪৫ হেক্টর, সৈয়দপুর ২৭৫, ডোমারে ৭৫০, ডিমলা ৮২০, জলঢাকা ৮৪৫ ও কিশোগঞ্জ উপজেলায় ৫৮০ হেক্টর। এতে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ হাজার ৮৬০ টন।
এই ফসল চাষে খরচ কম ও লাভ বেশি। এতে সেচ দিলেও চলে না দিলেও ফসল কমে না। বর্তমানে বাজারে প্রতি মণ সরিষার দাম ২ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। তা ছাড়া অনেকেই এবার সরিষার তেল করে রাখবেন। সরিষার তেল স্বাস্থ্যসম্মত হওয়ায় অনেকেই এখন সয়াবিন তেলের পরিবর্তে সরিষার তেল ব্যবহার শুরু করেছেন। তাই কৃষকরা এবার বেশি জমিতে সরিষার আবাদ করেছেন।
তা ছাড়া সরকারিভাবেও সরিষা আবাদের জন্য কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। সরিষা আবাদের জন্য দেওয়া প্রণোদনা। নীলফামারী সদরের চত্তরা রড়গাছা ইউনিয়নের লোকমান হোসেন জানান, এক বিঘা জমিতে সরিষা আবাদে (হাল, বীজ, সার) খরচ হয় ২ হাজার ৪০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত। ফসল হয় ৫ মণের মতো। এতে অনেক লাভ হয়।
কৃষক তাইজুল জানান, আমন ও বোরো চাষের মাঝখানে সরিষা চাষে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। বোরো ধানের ফলনও বেশি হয়। এ ছাড়া সরিষার ডাটা জ্বালানির কাজে ব্যবহার হয়। তবে অনেকেই অভিযোগ করে বলেন, সরকারিভাবে যাদের সরিষা আবাদের জন্য প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে তাদের বেশিরভাগেই সরিষা আবাদ করেনি। তারা বীজ ও সার বাজারে বিক্রি করে দিয়েছেন।
সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. কামরুল হাসান জানান, সরিষা চাষের পাশাপাশি মৌমাছিও চাষ করা যায়। এতে বাড়তি মুনাফা আসে। এবার সদরে ২ হাজার ৫৪৫ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। চলতি মৌসুমে তা শতভাগ (২ হাজার ৫৪৫ হেক্টর) অর্জন সম্ভব হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অর্জন বেশি হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে অধিক ফলন পেতে কৃষি কর্মকর্তারা মাঠপর্যায়ে কৃষকদের নানা পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। আশা করি, ভালো ফলন ও বাজারে ভালো দাম পেলে কৃষকরা লাভবান হবেন।
এসএন