নওগাঁয় সরিষা ও মৌমাছি চাষে লাভবান চাষিরা
নওগাঁর বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠজুড়ে এখন হলুদের ঢেউ। জেলার বিভিন্ন এলাকায় সরিষা ক্ষেতে ফলন আসায় এমন চোখ জুড়ানা দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। সরিষার এসব জমির পাশেই মৌ-বক্স বসিয়েছেন মৌ চাষিরা। এতে মৌমাছির মাধ্যমে সরিষা ফুলের পরাগায়ন সহায়তা হচ্ছে। ফলে একদিকে সরিষার উৎপাদন বাড়ছে অপরদিকে মধু আহরণ করা যাচ্ছে। সম্প্রতি এই চাষে সরিষা চাষি ও মৌ চাষি উভয়ই লাভবান হচ্ছেন।
কষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নওগাঁ জেলা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলার ১১টি উপজেলায় এই বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১১ হাজার ৫৫০ হেক্টর জমিতে বেশি সরিষার চাষ হয়েছে। গত বছর জেলায় সরিষার আবাদ হয়েছিল ৩৬ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে। গত বছরের অর্জন অনুযায়ী চলতি বছর জেলায় ৩৬ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এই বছর জেলায় ৪৭ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। এসব ক্ষেতের পাশে শুক্রবার (২৩ ডিসেম্বর) পর্যন্ত ৮ হাজার ২০০টি মৌ বক্স স্থাপন করা হয়েছে। এই বক্স থেকে এবার ১৫০ টন মধু সংগ্রহ হবে বলে ধারণা করছে কৃষি বিভাগ। প্রতি কেজি মধু ৩০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও এবার জেলায় সরিষার ফুল থেকে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকার মধু সংগ্রহ হতে পারে।
স্থানীয় কৃষক ও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ভোজ্য তেলর দাম বৃদ্ধির কারণে কৃষকরা এবার বেশি পরিমাণ জমিতে সরিষার আবাদ করেছেন। এ ছাড়াও গত মৌসুম সরিষার ভালো দাম পাওয়ায় কারণেও এবার অনেক কৃষক সরিষা চাষে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। চলতি বছরে বেশি পরিমাণ জমিতে সরিষা চাষ হওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে, এবার বর্ষায় বষ্টিপাত কম হয়। ফলে জেলার বিভিন্ন এলাকায় নিচু জমিগুলো থেকে এবার আগেই পানি নেমে যায়। ওই সব জমি বোর আবাদের জন্য দুই-তিন মাস ধরে ফেলে না রেখে কৃষকরা সেখানে সরিষার আবাদ করছেন। এ ছাড়াও ভোজ্য তেলের চাহিদা মেটাতে সরিষার আবাদ বাড়ানোর জন্য সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী কৃষি বিভাগ নানাভাবে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছেন। চলতি বছর ২৪ হাজার কৃষকের প্রত্যককে এক বিঘা জমিতে সরিষা চাষের জন্য বিনামূল্য বীজ ও সার বিতরণ করেছে কৃষি বিভাগ। এসব কারণে চলতি মৌসুম জেলায় সরিষার আবাদ বেড়ে গেছে।
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে জেলায় উচ্চ ফলনশীল (উফশী) বারি-১৪, বারি-১৫ ও বারি-১৭ জাতের সরিষা আবাদ হয়েছে। এ ছাড়াও স্থানীয় টরি-৭ জাতের সরিষার আবাদ করেছেন কৃষকরা। এসব জাতের সরিষা নভেম্বরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আবাদ করতে হয়। ফসল ঘরে উঠতে সময় লাগে জাত ভেদে ৭০ থেকে ৯০ দিন।
জেলার মান্দা উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে এখন সরিষা ফুলের সমারোহ। কৃষকরা যেমন মাঠে সরিষার পরিচর্যা করেছেন তেমনি ক্ষেতের পাশে মৌমাছির বাক্স বসিয়ে মধু সংগ্রহ করছেন মৌ চাষিরা।
রবিবার (২৫ ডিসেম্বর) নওগাঁ-রাজশাহী মহাসড়কের জয়বাংলা মোড় এলাকায় মান্দা উপজেলার কালিকাপুর ইউনিয়নের ছোট মল্লুকপুর মাঠে গিয়ে দেখা যায়, বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে সরিষার চাষ হয়েছে। মাঠজুড়ে হলুদের সমারোহ। মাঠের পাশে মহাসড়ক সংলগ্ন একটি কলাবাগানে ৪০০টি মৌ-বাক্স স্থাপন করেছেন মৌ চাষি আবুল কালাম আজাদ। রাজশাহীর কেশরহাট উপজেলা থেকে তিনি এসেছেন মধু সংগ্রহের জন্য।
মৌ চাষি আবুল কালাম আজাদ বলেন, ১৪ দিন হলো তিনি ওই মাঠে মধু সংগ্রহের জন্য বাক্স বসিয়েছেন। এখন পর্যন্ত তিনি ৪০০টি বাক্স থেকে দুই বার মধু সংগ্রহ করেছেন। প্রতিবার একটি বাক্স থেকে ৭-৮ কেজি মধু পাওয়া যায়। এখন পর্যন্ত ৫ হাজার ৮০০ কেজি মধু সংগ্রহ করছেন তিনি। আরও তিন সপ্তাহ ওই মাঠ থেকে মধু পাওয়া যাবে। সরিষার ক্ষেতে ফুল কমে গেলে তিনি মধু সংগ্রহের জন্য অন্য মাঠে চলে যাবেন।
মান্দার কালিকাপুর ইউনিয়নের পিড়াকর গ্রামে বিস্তীর্ণ সরিষা ক্ষেতের মাঠের পাশে একটি পুকুর পাড়ে ২০০টি বাক্স বসিয়েছেন ঠাঁকুরগাঁওয়ের সুজন হোসেন। তিনি জানান, নওগাঁর বিভিন্ন মাঠে গত ২০-২৫ দিন ধরে তার ৭০০টি মৌ বক্স বসানো আছে। এসব বাক্স থেকে এখন পর্যন্ত সংগ্রহ করা মধু ঢাকার বিভিন্ন কোম্পানির কাছ ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন।
চলতি বছর জেলার সবচেয়ে বেশি সরিষা চাষ হয়েছে মান্দা উপজেলায়। মান্দা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর উপজেলায় ৬ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও সরিষার চাষ হয়েছে ৮ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে। মান্দাতে সাতক্ষীরা, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়সহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ২২ জন মৌমাছি খামারি ৩ হাজার ৮০০টি বক্স নিয়ে এসেছেন মধু সংগ্রহ করতে। পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ের মৌ চাষিরাও মধু সংগ্রহ করছেন।
মান্দা উপজেলার কালিকাপুর ইউনিয়নের ফতেপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল মজিদ এবার ২৫ বিঘা জমিতে সরিষার আবাদ করেছেন। গত বছর ১৫ বিঘা জমিতে সরিষার চাষ করেছিলেন তিনি।
আব্দুল মজিদ বলেন, প্রতি বছর তিনি ৭ থেকে ৮ বিঘা জমিতে সরিষার চাষ করে থাকেন। সাধারণত অন্যান্য বছরগুলোতে মাঠের নিচু জমিগুলোতে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত পানি জমে থাকত। তবে এবার বর্ষায় বষ্টিপাত কম হওয়ায় নভেম্বরের আগেই নিচু জমিগুলো থেকে পানি নেমে গেছে। বোর ধান লাগানোর আগ পর্যন্ত দুই-তিন মাস ১০ বিঘা নিচু জমি ফেলে না রেখে সেগুলোতেও সরিষার আবাদ করেছেন। সরিষা গাছে ফুল ভালো এসেছে। আশা করছেন, ফলনও ভালো পাবেন।
এ ব্যাপারে মান্দা উপজেলার উপ-সহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা মুহাম্মদ শহিদুল্ল্যাহ বলেন, মৌমাছি সরিষার ফুলে উড়ে উড়ে বসে মধু সংগ্রহ করে। এতে সরিষা ফুলে সহজে পরাগায়ন ঘটে। তাই সরিষা খেতের পাশে মৌ চাষের বক্স স্থাপন করলে সরিষার ফলন অতিরিক্ত ২০ শতাংশ বাড়ে। পাশাপাশি মৌ চাষিরা মধু আহরণ করে লাভবান হোন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবু হোসেন বলেন, ভোজ্য তেলের চাহিদা মেটাতে এবার আমাদের নির্দেশনা ছিল সরিষার আবাদ বাড়ানার জন্য। আমরা চাষিদের উদ্বুদ্ধ করেছি। পাশাপাশি ভোজ্য তেলের দাম বৃদ্ধির কারণেও সংসারের খরচ কমাতে কৃষকরা সরিষার আবাদ বাড়িয়েছে। এ ছাড়াও এবার বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় নিচু জমিগুলোতে সরিষার আবাদ করতে পারছেন কৃষকরা। এসব কারণেই গত বছরের তুলনায় এবার বেশি পরিমাণ জমিতে সরিষার চাষ হয়েছে।
এসআইএইচ