আমদানীতে দুগ্ধ শিল্প ভেঙে পড়েছে
রাকিবুল হাসান, প্রতিনিধি, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
আজ ১ জুন। সারা বিশ্বে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব দুধ দিবস’। প্রধানত মায়ের দুধ, এরপর গরু, ছাগল, ভেড়া, উট, দুম্বার দুধ উৎপাদিত হয়। এই দুধ খেয়ে বড় হয় শিশুরা। নানা ধরণের খাদ্য তৈরি হয়। তবে বাংলাদেশে গরুর দুধের মান খুব খারাপ। এই নিয়ে গরুর খাবারের ওপর গবেষণা করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পশুপুষ্টি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মহি উদ্দিনের নেতৃত্বে ‘ইন্টিগ্রেটেড ডেইরি রিসার্চ নেটওয়ার্ক (আইডিআরএন)’। তিনি এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির সমন্বয়কারী।
‘বিশ্ব দুগ্ধ দিবস ২০২২’ আজ, আইডিআরএন গত এক বছরে বাংলাদশের টেকসই দুগ্ধ উৎপাদনে পরিবর্তনগুলোর কারণ ও ফলাফলগুলো প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি তারা এশিয়ার সবচেয়ে বড় কৃষি গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগার ব্যবহার করে দেশে টেকসই দুগ্ধ উৎপাদনে করণীয়সহ বিস্তারিত গবেষণা প্রকাশ করেছেন।
আইডিআরএনের গবেষণায় বলা আছে, ‘গরুর খাবারের মূল্য অতিরিক্ত মূল্য বাড়ানো ও তাদের খাবারগুলোর আমদানিনির্ভরতা বাংলাদেশের টেকসই দুগ্ধ উৎপাদনের বড় বাধা।’
তাদের নেটওয়ার্কের সমন্বয়কারী ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পশুপুষ্টি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বলেছেন, ‘আমাদের গবেষণায় জানা গিয়েছে, ২০২১ সালের মে থেকে ২০২২ সালের মে মাস পর্যন্ত দেশে গরু ও ছাগলের দুধের (গো-দুগ্ধ) দাম বেড়েছে গড়ে ১১.৬ টাকা। অথচ এই সময়ে তাদের খাদ্যের দাম বেড়েছে ৫৪ টাকা, যেখানে বিশ্বের বাজারে দাম বেড়েছে মোটে ২০.৬ টাকা। আমদানী করে আনতে হয় বলে একটিমাত্র অর্থবছরেই বাংলাদেশে বিশ্ববাজারের তুলনায় গো-খাদ্যের দাম ৩০.৯ টাকা বেশি হয়েছে। তাতে খামারি পর্যায়েও দুধের দাম বেড়েছে ২০ টাকা।’
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মহি উদ্দিন জানিয়েছেন, ‘৪৯.৬ টাকা থেকে ৫৯.২৮ টাকা কেজিতে এখন গরুর দুধ বিক্রি হয় খামারে। ক্রেতারা ৫৩ টাকা থেকে লাফিয়ে ৬৪.৫৪ টাকা কেজি দরে গরুর দুধ কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। গো-খাদ্যের অতিরিক্ত মূল্য বৃদ্ধিতেই ভোক্তা পর্যায়ে দুধের মূল্য এই দাম বেড়েছে।’
তাদের ‘ইন্টিগ্রেটেড ডেইরি রিসার্চ নেটওয়ার্ক (আইডিআরএন)’র মূল্যবান এই গবেষণায় আরো জানানো হয়েছে, ‘গো-খাদ্য হিসাবে সর্বাধিক ব্যবহৃত খাদ্যপণ্য হলো গমের ভুষি। পাশাপাশি ভুট্টা, সরিষার খৈল, ধানের কুড়া ব্যবহার হয়। এসব খাদ্যের বেশীর ভাগই আমদানি করতে হয়।’
তারা বলেছেন, ‘বিশ্বের যেসব দেশ থেকে এই খাদ্যগুলো আমদানি করা হয়, কোভিড-১৯ মহামারি রোগ, পরবর্তী সময় ও সাম্প্রতিক ইউরোপের অতিরিক্ত শুকনো মৌসুম বলে দাম তাদের বেড়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত হওয়ায় সংকটটি আরো বেড়েছে। ফলে গত একটি বছরেই ভুট্টার দাম শতকরা ৯০ শতাংশ বেড়েছে। গমের ভুষি ৬২.৯, সরিষার খৈল ৩৫.৩, ধানের কুড়ার ৩০.৩ মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। খাদ্যগুলোর অতিরিক্ত মূল্য বৃদ্ধির কারণেই দুগ্ধ খামারীদের লাভে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। গরুর দুধের আকালও পড়েছে।’
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মহি উদ্দিন জানিয়েছেন, ‘এই অবস্থায় বাংলাদেশের দুগ্ধ উৎপাদন হুমকিতে পড়েছে। খামারিরা লোকসানে পড়েছেন। তারা অসহায় আছেন।’
এই অবস্থায় খামারিদের প্রতি আইডিআরএনের পরামর্শ, ‘আপনারা উচ্চমূল্যের গমের ভুষিসহ অন্যান্য দামী উপাদানের বিকল্প হিসেবে হাতের কাছে পাওয়া যায় এমন সস্তা উপাদানের আদর্শ খাদ্যতালিকা ব্যবহার করতে পারেন।’
“গমের ভুষির বদলে কচি নেপিয়ার ও ভুট্টার ঘাস খাওয়াতে পারেন গরু, ছাগলকে। সঙ্গে ‘লিগুমিনাস’ দিতে পারলে খাবারের সমস্যা বহুগুণে কমানো যাবে। লিগুমিনাস হলো-মটরশুটি, কলাই, পেয়াজ, রসুনের কোয়া, শিম, বরবটি, মটরদানা, ডাল, চানা, বুট, ছোলা, চীনাবাদাম, মশুর গাছ, লুপিন (বিচিত্র রঙের ফুলের আলাদা গো-খাদ্য বৃক্ষ), তেতুল, তেতুল গাছ, আলফালফা (পশুখাদ্য বৃক্ষ), ক্লোভার (পশুখাদ্য বৃক্ষ)।’
তারা জানিয়েছেন, ‘তাছাড়াও সাধারণ খড় খাওয়াতে পারেন। বেইল খড়ও ব্যবহার করা যেতে পারে।’
‘গো-খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থাপনা, তাদের বাজার ব্যবস্থাপনা, সরবরাহ পদ্ধতি ও জড়িত সব চাষীকে সমন্বয় করতে হবে। প্রয়োজনে ভালো মানের উদ্যেক্তা তৈরী করার পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে’-পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা।
আইডিআরএন নেটওয়ার্কের সমন্বয়কারী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মহি উদ্দিন আরো জানিয়েছেন, “বাংলাদশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূবাঞ্চলের ২৩টি জেলায় আমাদের মাধ্যমে ইউএসএইড ‘ফিড দ্যা ফিউচার লাইভস্টক অ্যান্ড দেয়ার নিউট্রেশন’ কার্যক্রম পরিচালনা করছে।”
তিনি বলেছেন, ‘আমাদের সবার গবেষণার ফলাফলগুলো ব্যবহার করে বাংলাদেশে গো-খাদ্য সমস্যার যুগোপযোগী ও ফলপ্রসূ সমাধান সম্ভব।’
ড. মোহাম্মদ মহি উদ্দিন বলেছেন, ‘বাংলাদেশের খামারিদের জন্য সরকারের প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তরের গৃহীত পদক্ষেপগুলো আরো বেগবান করলে পশুসম্পদ বাঁচবে, ভালো থাকবে।’
‘খামারিদের দুগ্ধ উৎপাদন খরচ কমালে বাংলাদেশের দুগ্ধ শিল্প বিকশিত ও মানসম্পন্ন হবে’-জানিয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পশুপুষ্টি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।
ওএস।