ফেসবুক-ইউটিউবের বিজ্ঞাপনে ৩০% ভ্যাট দিতে হচ্ছে
ছবি: সংগৃহীত
অনলাইনে বিজ্ঞাপনদাতাদের জন্য এ যেন শাঁখের করাত! একবার ফেসবুক-ইউটিউব ভ্যাট বসাচ্ছে, আরেকবার স্থানীয় ব্যাংকগুলো। আগে যেখানে ভ্যাটই ছিল না, গত ৩ বছর থেকেই এভাবেই দুইবার ১৫ শতাংশ করে মোট ৩০ শতাংশ কর গুনতে হচ্ছে।
সম্প্রতি ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফেজবুকে বিজ্ঞাপন দেওয়া এমন একজন ভুক্তভূগি জাহিদুল ইসলাম জানান, আমি ঠিক ১০ ডলারের এড ক্যাম্পেইন করি। আমার ১০ ডলার টিমিট করাও ছিল। এরপর আমার কার্ড থেকে ১১.৫০ ডলারের মেসেজ পাই। সব মিলে আমার কার্ড থেকে ১৫৩৪ টাকা কেটে নেওয়া হয়। এ দিনের ডলার রেট ছিল ১১৫ টাকা। ব্যাংক থেকে আর অতিরিক্ত ১৫% ভ্যাট কাটা হয়েছে। এমনিতে ফেজবুকে ১৫% আবার ব্যাংক থেকে ১৫% ভ্যাট কাটা খুবই দুঃখ জনক। টোটাল ৩০% ভ্যাট নেওয়া হচ্ছে। ২০২১ সাল থেকে এভাবেই ৩০% ভ্যাট নেওয়া হচ্ছে। যা বেআইনি বলে আমি মনে করছি।
এ বিষয়ে ব্যাংকটির কল সেন্টার থেকে জানানো হয়, ১১.৫০ এটা ফেজবুক ভ্যাটসহ নিয়েছে। ব্যাংক থেকে আলাদাভাবে গভর্নমেন্ট ভ্যাট হিসেবে কেটে নেওয়া হয়েছে।
গণমাধ্যমে একাধিক অভিযোগ আসার পর নথিপত্র বিশ্লেষণ করে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। এরপর বিভিন্ন ব্যাংকে যোগাযোগ করা হলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের কার্ড বিভাগের কর্মকর্তারাও দ্বৈত ভ্যাটের এই হয়রানির কথা স্বীকার করেন।
কর্মকর্তারা বলছেন, অনিবাসী প্রতিষ্ঠানগুলোর ভ্যাট কর্তনের নির্দেশনা পাওয়ার পরই ব্যাংকগুলো তাদের সফটওয়্যারের মধ্যে এই মোডিফিকেশনটা নিয়ে আসে, যাতে করে এই ধরনের লেনদেন যখনই হবে তখন (বিজ্ঞাপনদাতা) গ্রাহকদের থেকে ১৫ শতাংশ ভ্যাট স্বয়ংক্রিয় কর্তন করা সম্ভব হয়।
ওদিকে গত ২০২১ সালের জুলাই থেকে ফেসবুকের সঙ্গেও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের বোঝাপড়া হয়েছে যে তারা এ দেশে লিয়াজোঁ অফিস খুলে নিজেরাই ভ্যাট কেটে সরকারের কাছে জমা দেবে। কিন্তু এ ব্যাপারে সরকার বা এনবিআর থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা না দেওয়ায় ব্যাংকগুলো আগের মতোই ভ্যাট কাটছে। আবার ফেসবুকও বিলের ওপর ভ্যাট কর্তন করে গ্রাহকদের পাঠাচ্ছে।
দ্বৈত ভ্যাটের অভিযোগ নিয়ে জানতে চাইলে এনবিআরের সদস্য (মূসক নীতি) মো. মাসুদ সাদিক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এটা হওয়ার কথা নয়। এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে এ ধরনের কোনো অভিযোগ আসেনি। এর পরও এ রকম হয়ে থাকলে সুনির্দিষ্ট তথ্যসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিপক্ষের পক্ষ থেকে আমাদের কাছে আবেদন করা হলে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।’
জানা যায়, ব্যাংকগুলো তাদের আদায় করা ১৫ শতাংশ ভ্যাটই সরকারি কোষাগারে জমা দিচ্ছে।
ওদিকে ফেসবুকসহ অন্য অনেক অনাবাসী প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনের আয়ের ওপর ভ্যাট দেওয়া শুরু করলেও এখানে লুকোচুরি করা হচ্ছে বলে জোরালো অভিযোগ উঠেছে।
‘মূল্য সংযোজন কর আইন-১৯৯১-এর ধারা ৩-এর উপধারা (৩)-এর দফা (ঘ) অনুযায়ী, বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমার বাইরে থেকে সেবা (যেমন-রয়ালটি, বিভিন্ন ইন্টারনেট সার্ভিস, ফেসবুক, ইউটিউবসহ সব মাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচার ইত্যাদি) সরবরাহের ক্ষেত্রে সেবা গ্রহণকারীর কাছ থেকে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আদায়যোগ্য। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউব, অ্যামাজন, গুগল, মাইক্রোসফট প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান এই হিসাবে ভ্যাট কাটছে। নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো যখন মাস্টার কার্ড, ভিসা কার্ড, টিটি বা অন্য কোনো মাধ্যমে যখন এই বিলের টাকা পেমেন্ট করছে, তখন ব্যাংকগুলো আবার ১৫ শতাংশ ভ্যাট কেটে নিচ্ছে।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেয় গত ২০২১ সালের ২৪ জুলাই থেকে ২৩ আগস্ট পর্যন্ত ১৯ হাজার ৮৪৬ টাকার।
এর সঙ্গে ১৫ শতাংশ ভ্যাট যোগ করে ফেসবুক কেটে নেয় ২২ হাজার ৮২২ টাকা ৪৪ পয়সা। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকটি ক্রেডিট কার্ডের বিলে আরো ১৫ শতাংশ ভ্যাট যোগ করে বিল পাঠায় ৩০৯ ডলার ৩৩ সেন্ট। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ২৬ হাজার ৪০০ টাকা প্রায়।
অনিবাসী প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভ্যাটের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে গত কয়েক বছর ধরেই। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অনুরোধে ২০১৯ সালের মার্চে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে একটি নির্দেশনা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এতে বলা হয়, মাস্টার কার্ড, ভিসা কার্ড বা টিটি অথবা যেকোনো মাধ্যমে পেমেন্ট হলেই ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট কেটে সরাসরি ট্রেজারিতে জমা করতে হবে। এর পরও ভ্যাট আদায় যথার্থভাবে হচ্ছিল না। ফলে গত আগস্টে এনবিআরের অনুরোধে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আরেকটি সার্কুলার জারি করা হয়।
এতে গত ২০২১ সালের ২৪ জুন অনুষ্ঠিত এনবিআরের সভার সিদ্ধান্ত জানিয়ে বলা হয়, অনিবাসী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সেবার বিপরীতে নেওয়া ভ্যাটের বিবরণী পরের মাসের সাত দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে এনবিআর এবং সংশ্লিষ্ট মূসক এজেন্টের কাছে পাঠাতে হবে।
সরকারের স্পষ্ট নির্দেশনা দাবি করে ভুক্তভোগীরা বলছেন, দেশের তফসিলি ব্যাংকগুলোই ভ্যাট কর্তন করে সরকারি কোষাগারে জমা দিচ্ছে দিক, এ ক্ষেত্রে ফেসবুককে ১৫% ভ্যাট কাটা বন্ধ করতে হবে।