প্রত্যাবর্তনে রিয়াল মাদ্রিদের শেষ মুহূর্তের যাদু
ছবি: সংগৃহীত
অবিশ্বাস্য! বাস্তবে একই ঘটনা বারবার ঘটতে পারে? এ যেন কল্পনাকেও হার মানানো। এমন ঘটনা গল্পে বা সিনেমার চিত্রনাট্যে লেখকের ইচ্ছায় দেখা যেতে পারে যত্রতত্র। তাই বলে বাস্তবে? একবার বা দুইবার নয়, তিন তিনবার। উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগে রিয়াল মাদ্রিদ নকআউট পর্বের শেষ ষোলো থেকে শুরু করে কোয়ার্টার ফাইনাল, এরপর সেমি ফাইনালেও তারা প্রত্যাবর্তনের গল্প লিখে পৌঁছে গেছে ফাইনালে। যেখানে তারা সঙ্গী হিসেবে পেয়েছে ইংলিশ ক্লাব লিভারপুলকে। দুই দল ফাইনালে মুখোমুখি হবে ২৮ মে প্যারিসে।
রিয়াল মাদ্রিদ এই অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তনের গল্প লেখার পথে একে একে পেছনে ফেলেছে শেষ ষোলোতে ফ্রান্সের প্যারিস সেন্ট জার্মাইকে (পিএসজি), কোয়ার্টার ফাইনালে বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডের চেলসিকে। সর্বশেষ বুধবার (৪ মে) রাতে ইংল্যান্ডের আরেক ক্লাব বর্তমান রানার্সআপ ম্যানচেষ্টার সিটিকে।
উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে প্রত্যাবর্তনের অনেক গল্প আছে। কিন্তু সেগুলো ছিল কোনো কোনো আসরে কোনো একটি নির্দিষ্ট ক্লাবের একটি নির্দিষ্ট ম্যাচে। কিন্তু রিয়াল মাদ্রিদের মতো এক আসরে টানা তিন ম্যাচে এ রকম প্রত্যাবর্তনের ঘটনা ফুটবলে বিশ্বে এই প্রথম।
প্রত্যাবর্তেনের সেরা গল্প বলা যায় বার্সেলোনার ক্ষেত্রে। ২০১৬ সালে পিএসজির মাঠে ৪-০ গোলে হেরে ন্যু ক্যাম্পে নিজেদের মাঠে খেলতে নেমেছিল বার্সেলোনা। পিএসজি ফাইনালে, ফুটবল খেলা যিনি বুঝেন না, তিনিও পিএসজির পক্ষে বাজি ধরবেন। কিন্তু মেসি-নেইমার-সুয়ারেজের সমন্বয়ে গড়া আক্রমণভাগ হাল ছাড়তে রাজি ছিল না। খেলা শেষ হওয়ার ৩ মিনিট আগে ৩ গোল করে তারা ৬-১ গোলে ম্যাচ জিতে অবিশ্বাস্য ঘটনার জন্ম দিয়েছিল ফুটবল বিশ্বে। ৫০ মিনিটে বার্সেলোনা ৩ গোল করার পর ৬২ মিনিটে কাভানির গোলে পিএসজির পাল্লা আবার ভারী হয়ে উঠে। খেলা গড়াচ্ছে শেষের দিকে। পিএসজিকে টপকাতে হলে বার্সেলোনাকে করতে হবে আরও ৩ গোল যা এক কথায় অবিশ্বাস্য। কারণ খেলা শেষ হতে বাকি মাত্র ২ মিনিট। সঙ্গে যোগ হবে কয়েক মিনিট ইনজুরি টাইম। ৮৮ মিনিটে ১ গোল ও ইনুজরি টাইমে আরও ২ গোল করে বার্সেলোনা জন্ম দিয়েছিল প্রত্যাবর্তনের সেরা গল্প।
যে রূপকথার জন্ম দিয়েছিল বার্সেলোনা, সেই বার্সেলোনাই নিজেরা আবার তার শিকার হয়েছিল ২০১৯ সালে। লিভারপুলের কাছে। নিজেদের মাঠে বার্সেলোনা জিতেছিল ৩-০ গোলে। কিন্তু লিভারপুলের মাঠে গিয়ে তারা ৪-০ গোলে হেরেছিল। ২০০৪ সালে ইতালির ক্লাব এসি মিলান কোয়ার্টার ফাইনালে স্প্যানিশ ক্লাব দেপোর্তিভো লা করুনার কাছে এ রকম ঘটনার শিকার হয়েছিল। প্রথমে নিজেদের মাঠে ৪-১ গোলে জিতে গিয়েছিল দেপোর্তিভোর মাঠে। কিন্তু সেখানে গিয়ে হেরে বসে ৪-০ গোলে। ফলে ৫-৪ ব্যবধানে জিতে সেমিতে উঠে যায় স্প্যানিশ ক্লাবটি।
ফাইনালেও আছে এ রকম একটি প্রত্যাবর্তনের গল্প। এখানেও শিকার এসি মিলান। এবার তারা ফাইনালে শিকার হয় ইংলিশ ক্লাব লিভারপুলের কাছে। ২০০৫ সালে ইস্তামবুলে অনুষ্ঠিত ফাইনালে এসি মিলান এক পর্যায়ে ৩-০ গোলে এগিয়ে যায়। ফাইনাল এখান থেকে শিরোপা না জেতার কোনো কারণই নেই। কিন্তু লিভারপুল সেখানে নতুন ঘটনার জন্ম দেয়। মালদিনির জোড়া ও ক্রেসপোর এক গোলে প্রথমার্ধেই এসি মিলান ৩-০ গোলে এগিয়ে যায়। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে মাত্র ৩ ও ৬ মিনিটের ব্যবধান ৩ গোল পরিশোধ করে লিভারপুল অবিশ্বাস্যভাবে খেলায় ফিরে আসে। নির্ধারিত সময় খেলা ৩-৩ গোলে ড্র থাকার পর টাইব্রেকারে লিভারপুল ৩-২ গোলে জিতে এসি মিলানের মুখের খাবার কেড়ে নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আনন্দে মেতে উঠে।
এ সবই হার মেনেছে রিয়াল মাদ্রিদের প্রত্যাবর্তনের কাছে। বিপদ সংকুল পথ পাড়ি দিয়ে এক একটি বাধা অতিক্রম করেছে। শেষ ষোলোতে তারা পিএসজির মাঠে ১-০ গোলে হেরে নিজেদের মাঠেও প্রথমে ১ গোল হজম করে আরও বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরে বেনজামার হ্যাটট্রিকে ৩-১ গোলে ম্যাচ জিতে ৩-২ ব্যবধানে বাধা অতিক্রম করে কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছে। এখানে তারা পায় বর্তমান চ্যাম্পিয়ন চেলসিকে।
স্ট্যাম্পফোর্ড ব্রিজে চেলসির মাঠে তারা বেনজামার আরেকটি হ্যাটট্রিকে ৩-১ গোলে ম্যাচ জিতে সেমির পথে এক পা দিয়েই রাখে। কারণ খেলা হবে আবার নিজেদের মাঠে। কিন্তু এবার চেলসি জন্ম দিতে চেয়েছিল প্রত্যাবর্তনের নতুন গল্প। ১৫, ৫১ ও ৭৫ মিনিটে তারা ৩ গোল করে ২ লেগ মিলিয়ে তারা এগিয়ে যায় ৪-৩ ব্যবধানে। ৮০ মিনিটে রিয়াল মাদ্রিদ একটি গোল পরিশোধ করে খেলায় সমতা আনে ৪-৪। এরপর খেলা গড়ায় ইনজুরি টাইমে। আর তখনই ত্রাতা হয়ে হাজির হন সেই করিম বেনজামা। ইনজুরি টাইমের ৬ মিনিটে তিনি গোল করে একই আসরে প্রত্যাবর্তনের দ্বিতীয় গল্প লেখেন। তারপর আসে সেমি ফাইনাল।
ম্যানসিটির মাঠে তারা ৪-৩ গোলে হেরে নিজেদের মাঠে আসে। বাঁধা অতিক্রম করতে হলে ২ গোলে জিততে হবে। সেখানে গোলই হচ্ছিল না। ৭৩ মিনিট গিয়ে উল্টো গোলই হজম করে বিদায়ের ধ্বনি শুনতে থাকে। খেলার শেষ বাঁশি বাজার অপেক্ষায়। যে কেনো সময় বাজতে পারে বাঁশি। আর রেফারির বাঁশি বাজলেই ফাইনালে টানা দ্বিতীয় বারেরমতো ফাইনালে উঠে যাবে ম্যানসিটি। আবার টানা দ্বিতীয়বারের মতো হবে অল ইংলিশ ফাইনাল। কিন্তু এই আসর যাদের প্রত্যাবর্তনের গল্পে ভরা তারা কী এতো সহজে বিদায়ের ধ্বনি শুনতে চাইবে? যেখানে আছেন আবার করিম বেনজামা নামে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা এক ফুটবলার। তাইতো রেফারির শেষ বাঁশি বাজার আগেই ব্রাজিলিয়ান নতুন সেনসেশন রদ্রিগো ৯০ মিনিটে গোল করে দলকে উজ্জীবিত করে তুলেন। কিন্তু তখনো তাদের বিদায় ঘণ্টার শঙ্কা কাটেনি। ৫-৪ গোলে পিছিয়ে। এ সময় শুরু হয় ইনজুরি টাইম। ডিসপ্লেতে দেখানো হয় ৬ মিনিট। রিয়ালের জন্য পোয়াবারো। প্রথম মিনিটেই রদ্রিগো আবারও গোল করে দলকে ২-১ গোলে এগিয়ে নেন। এদিকে দুই লেগ মিলে খেলায় তখন সমতা ৫-৫। নির্ধারিত সময় খেলা শেষ হলে ফলাফল ৫-৫ থাকায় খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। ৫ মিনিটেই ত্রাতা হয়ে হাজির হন সেই করিম বেনজামা। পেনাল্টি থেকে গোল করে তিনি দলকে ৩-১ ব্যবধানে এগিয়ে নেন। যা দুই লেগ মিলে রিয়াল মাদ্রিদ প্রথমবারের মতো এগিয়ে যায় ৬-৫ গোলে। খেলার বাকি সময় ম্যানসিটির পক্ষে আর সম্ভব হয়নি। এই ব্যবধান কমানোর। ফলে এক আসরে রিয়াল মাদ্রিদ টানা তিন ম্যাচে প্রত্যাবর্তনের গল্প লিখে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করে।
এবার দেখার পালা ফাইনালে তারা লিভারপুলের বিপক্ষে কী করে?
এমপি/আরএ/