সাকিবের ব্যাপারে কোহলির অবস্থাও সামনে এসেছিল
বিসিবির কৌশলী অবস্থানের কারণে সাকিব আল হাসান নিজের অবস্থান থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। যখন-তখন সাকিব জাতীয় দলের হয়ে টেস্ট ম্যাচ না খেলাটাকে অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছিলেন। বিসিবিও তার সেই সব অন্যায় আবদার অদৃশ্য কারণে একের পর এক মেনে নিচ্ছিল।
বিসিবি থেকে এ রকম সবুজ সংকেত পেতে থাকায় সাকিবও ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন। বিপিএলের ফাইনালের আগের দিন অফিসিয়াল ফটোসেশনে তিনি একটি বিজ্ঞাপনের শ্যুটিংয়ের কারণে আসনেনি। ভেঙেছিলেন বায়োবাবলও।
বিসিবি এখানেও নেয়নি কোনো ব্যবস্থা। আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ চলাকালীনও তিনি একইভাবে একটি প্রতিষ্ঠানের প্রণ্যের প্রচার অনুষ্ঠানও গিয়েছিলেন। পরিসংখ্যান খুঁজলে এ রকম ঘটনার সিরিয়াল অনেক লম্বা হবে। একের পর এক এ সব ঘটনায় পার পেয়ে সাকিব আবারও বিস্ফোরণ ঘটান দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে না যেতে চেয়ে। এখানে তিনি প্রথমে বলেছিলেন শুধু ওয়ানডে সিরিজ খেলবেন। টেস্ট সিরিজ খেলবেন না। টেস্ট সিরিজ না খেলার কারণ ছিল আইপিএল। কিন্তু আইপিএলে তিনি দল না পেলে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে টেস্ট সিরিজ খেলার বিষয়টি সামনে চলে আসে। এক পর্যায়ে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন আফগানিস্তানের বিপক্ষে চট্টগ্রামে ওয়ানডে সিরিজ শেষে ঐদিন নিজেই ঘোষণা দেন সাকিবের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে টেস্ট খেলার কথা। কিন্তু ৬ মার্চ দুবাই যাওয়ার প্রাক্কালে হযরত শাহজালাল আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরে সাকিব ‘বোমা’ ফাটান। বলেন শারীরিক ও মানসিক অবসাদের কারণে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা সফেরে যেতে চাচ্ছেন না।
বিষয়টি মোটেই ভালোভাবে নেননি বিসিবি সভাপতি। তিনি শক্ত হাতে বিষয়টি হ্যান্ডেল করার কথা জানিয়েছিলেন। বোর্ড সভাপতির খুবই কাছের পরিচালক খালেদ মাহমুদ সুজন ছিলেন আরেক কাটি সরস। তিনি সাকিবের এ জাতীয় ঘটনার ‘ফুলস্টপ’চেয়েছিলেন। বলেছিলেন সাকিব টেস্ট না খেললে অবসর নিতে পারে।
এ সব ঘটনায় বিসিবি সাকিবকে দুইদিন সময় দিয়েছিল এবং দেশে ফিরে আসার পর তার সঙ্গে বসে তার কাছে পরিকল্পনা জানার কথা বলা হয়। কিন্তু বিসিবি সাকিবের ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করেনি। ৯ মার্চ নিজেরা বসেই সিদ্ধান্ত নেয় সাকিবকে ৩০ এ্প্রিল পর্যন্ত সব ধরনের ক্রিকেট থেকে বিশ্রাম দেওয়ার। এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বিসিবির পক্ষ থেকে দুবাইতে সাকিবের সঙ্গে কয়েকদফা টেলিফোনে আলাপ করা হয়েছিল। সেখানে সাকিব নিজের অবস্থানেই অটল ছিলেন। বিসিবির এমন সিদ্ধান্তকে অনেকেই ‘মাইন্ড’ গেম হিসেবে দেখেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় সাকিব শেষ পর্যন্ত নিজের সিদ্ধান্ত বদল করে বিসিবির কাছে আত্মসমর্পন করেন। দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে নিজেকে এভেলেইবল এবং একই সঙ্গে তার বিশ্রাম ও ছুটির বিষয়টিও বিসিবি দেখবে বলে জানান।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে সাকিবের এবারের বিষয়টিকে বিসিবি অতীতের যে কোনো ঘটনার চেয়ে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে দেখেছে। সরকারের উচ্চপর্যায়েও আলাপ করা হয়েছে। সাকিবের এমন ঘটনাকে কেউই মেনে নিতে পারেননি। বারবার দেশের হয়ে খেলতে অবজ্ঞা করাকে শক্তভাবে দেখার কথাও বলা হয়। সাকিব নিজেও তার এবারের ঘটনায় কোথায়ও সমর্থন পানননি। অতীতে তিনি কম-বেশি সমর্থন পেতেন। যা তাকে বেপরোয়া করে তুলতে ইন্ধন যুগিয়েছিল।
বিসিবি ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সাকিবকে সব ধরনের ক্রিকেট থেকে বিশ্রাম দেয়ার পাশাপাশি কিভাবে এটিকে আরো শক্তভাবে দমন করা যায় এ নিয়ে চলে আলাপ-আলোচনা। আসে বিভিন্ন রকমের সিদ্ধান্ত। ম্যাচ ফিক্সিংয়ের ঘটনা গোপন করে আইসিসি কর্তৃক এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ হওয়ার সময় বিসিবি খুব ভালোভাবে সাকিবের পক্ষে অবস্থান নিয়ে তার মনোবল ভাঙ্গতে দেয়নি। কিন্তু সাকিব এ সব ঘটান বেমালুম ভুলে যাওয়াতে বিসিবির কোন কোন পরিচালক তাকে আর ছাড় না দেয়ার কথাও জানান। কেউ কেউ ভারতের বিরাট কোহলির ঘটনাও সামনে নিয়ে আসেন। ভারতীয় ক্রিকেট দলে একক আধিপত্য দেখানো বিশ্ব সেরা ব্যাটসম্যান বিরাট কোহলির মুখের উপর কথা বলার কেউ ছিলেন না। কিন্তু সমেয়র পরিক্রমায় সেই কোহলি নিজেল অবস্থান হারিয়েছেন। তিনি এখন ঢাল-তলোয়ার বিহীন শুধুই এক ক্রিকেটার।
পরিচালকদের কেউ কেউ কোহলির চেয়ে সাকিব বড় ক্রিকেটার নয় উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দেন। নিজেদের মাঝে এ রকম আলাপ-আলোচনার পর বিসিবির পক্ষ থেকে এক প্রকার সিদ্ধান্ত হয়ে যায় সাকিবকে ছাড় না দেওয়ার। যে কারণে সাকিব দেশে আসার পর আজ মিরপুরে বৈঠকে বসার আগে বিসিবির সভাপতির সঙ্গে দুই দফা টেলিফোনে কথা বলেন। যেখানে সাকিব ছিলেন আগে অনঢ়, সেখানে এবার বিসিবির সভাপতির ছিল অনঢ় অবস্থান। সাকিবও বুঝতে পেরেছিলেন এবার আর তিনি আগের মতো করে পার পাবেন না। তাই মিরপুরের বৈঠকে এসে তিনি এক রকম আত্মসমপর্ণই করেন। এখন মোহামেডানের হয়ে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে মোহামেডানের হয়ে প্রিমিয়ার লিগ খেলতে না পারার বিষয়টিও সাকিবকে নমনীয় হতে কিছুটা ভূমিকা রেখেছিল বলে অন্য একটি সূত্রে জানা গেছে।
বিসিবি সভাপতি অবশ্য সাকিবকে সম্মান দিয়ে বিদ্যমান ঘটনাকে তার মানসিক সমস্যা বলে উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, ‘এখন আমরা ওকে সাপোর্ট করি। এখানে কোনো চাপ নেই, কিচ্ছু নেই। সে স্বতঃস্ফূর্তভাবে খেলতে চাইলে অবশ্যই আমরা তাকে স্বাগত জানাই।
তিনি বলেন, ‘সিনিয়র ক্রিকেটারদের ওপর কিন্তু অনেক চাপ। আমাদের এ বছর ১৪টা ওয়ানডে, ১৫টা টি-টোয়েন্টি, ৮টা টেস্ট আছে। টানা এত খেলা তাদের জন্য আসলেই অসুবিধার। এটা আমাদেরকে বুঝতে হবে। যদি কেউ কোনো ফরম্যাট খেলতে না চায়, তাহলে আগে আগে বলে দিবে। কিন্তু সিরিজের আগমুহূর্তে বললে আমাদের জন্য বিরাট সমস্যা।’
এমপি/এমএমএ/