কমিটি বাতিল আর গঠন খেলায় সিলেট ছাত্রলীগ
দেশের আন্দোলন, সংগ্রাম আর প্রাচীন সংগঠনের নাম ছাত্রলীগ। তবে পূর্বের সেই অবস্থায় নেই ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠন। কেন্দ্রের মতো জেলায় জেলায় বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে নাম আসছে এই সংগঠনের। চাঁদাবাজি, খুন, ছিনতাই, টেন্ডারবাজি ও জায়গা দখলসহ নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিতর্কিত হচ্ছে এই সংগঠন। সংগঠনের পদ-পদবী পেয়ে নেতারা সাংগঠনিক কার্যক্রম ও সাংগঠনিক আদর্শ বেমালুম ভুলে যান। ফলে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক বিস্তৃতি না হলেও পকেট ভারি হচ্ছে নেতাদের। একই অবস্থা সিলেট ছাত্রলীগেও। বিতর্কিত বিভিন্ন ঘটনায় সিলেট ছাত্রলীগের কমিটি বারবার বিলুপ্ত হয়েছে। পরে ফের কমিটিও হয়েছে। কমিটি বিলুপ্ত আর নতুন গঠন করার খেলায় কেটে গেছে কয়েক বছর। এই খেলায় অনেকের চলে যায় চাত্রত্ব। ফলে সাংগঠনিক অবস্থাও তথৈবচ। ফলে সংগঠনের অনেক প্রতিশ্রুতিশীল তরুণদের হারাচ্ছে ছাত্রলীগ। আর যারা স্থান পাচ্ছেন, তাদের উপর ভরসা করতে পারছে না কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া প্রাণোচ্ছল কর্মীরা।
সর্বশেষ ২০২১ সালের ১২ অক্টোবর নতুন কমিটি পায় সিলেট ছাত্রলীগ। জেলা শাখায় নাজমুল ইসলামকে সভাপতি ও রাহেল সিরাজকে সাধারণ সম্পাদক এবং মহানগর শাখায় কিশোয়ার জাহান সৌরভকে সভাপতি ও নাঈম আহমদকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মনোনীত করা হয়। এই কমিটি ঘোষণার পর সিলেট ছাত্রলীগে বিদ্রোহ দেখা দেয়। ঝাড়ু মিছিল, প্রতিবাদ সমাবেশ, সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। কোটি টাকার বিনিময়ে এই কমিটি দেওয়া হয়েছে বলেও তখন অভিযোগ উঠে। এই ৪ নেতায় ইতিমধ্যে বছর অতিক্রম করেছেন। তবে এক বছরে এই ৪ নেতা ‘হিরো’ হলেও সাংগঠনিক অর্জন নেই উল্লেখযোগ্য।
ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা বলছেন, সিলেটে ছাত্রলীগের এত দূরাবস্থা আগে কখনো দেখা যায়নি। নেতৃত্বের ‘অদূরদর্শীতায়’ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এই ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনের সিলেট শাখাকে ‘ধ্বংস’ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তাদের।
জানা গেছে, জেলা ছাত্রলীগের অধীনে রয়েছে ১৩টি উপজেলা, ৫টি পৌরসভা এবং ১২টি কলেজ ইউনিট। সেপ্টেম্বর অবধি এই ৩০টি ইউনিটের মধ্যে মাত্র ৪টিতে কমিটি গঠন করতে পেরেছে জেলার নেতৃত্ব। ফেঞ্চুগঞ্জ, বালাগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলা এবং বালাগঞ্জ ডিগ্রি কলেজে কমিটি দেওয়া হয়েছে।
একই অবস্থা মহানগর ছাত্রলীগের। তাদের অধীনস্থ ২৭টি ওয়ার্ড ইউনিট রয়েছে। তবে ২৭টি ইউনিটে এক বছরের অর্জন মাত্র ৩ ইউনিটে কমিটি গঠন।
ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান কমিটির আগে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সর্বশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছিল ২০১৪ সালের ৮ সেপ্টেম্বর। সেদিন ১০ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এরপর ২০১৫ সালের ৪ ডিসেম্বর আরও ১৩১ জনকে অন্তর্ভুক্ত করে ১৪১ সদস্য বিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হয়। জেলা ছাত্রলীগের ওই কমিটি ২০১৭ সালের ১৮ অক্টোবর বিলুপ্ত ঘোষণা করে কেন্দ্র। অভ্যন্তরীণ বিরোধের জের ধরে ছাত্রলীগ কর্মী ওমর মিয়াদ হত্যাকাণ্ড এবং এ ঘটনায় জেলা ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক রায়হান চৌধুরী প্রধান আসামি হওয়াকে কেন্দ্র করে কমিটি বিলুপ্ত করা হয়।
একইভাবে বর্তমান মহানগর ছাত্রলীগের কমিটির আগে ২০১৫ সালের ২০ জুলাই সিলেট মহানগর ছাত্রলীগের চার সদস্য বিশিষ্ট আংশিক কমিটি অনুমোদন করে কেন্দ্র। তিন বছরেও এ শাখায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হয়নি। উল্টো একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে সমালোচিত হয় মহানগর ছাত্রলীগের ওই কমিটি। অবশেষে ২০১৮ সালের ২১ অক্টোবর এই কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। একইসঙ্গে ওই কমিটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল আলীম তুষারকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়।
সাংগঠনিক কার্যক্রমে এখনও সরব জেলা ছাত্রলীগ নেতা জানান, ‘সঙ্গত কারণেই আমার নামটি প্রকাশ করবেন না। কারণ দীর্ঘদিন ছাত্রলীগ করার অর্থই হচ্ছে একটি সাংগঠনিক পরিচিত লাভ। সেই জায়গায় থেকে বলছি- আমি এবং আমরা ভালো নেই। কেন্দ্রের অবস্থাও একই। কারণ তৃণমূলের অভিযোগকে কখনোই গ্রাহ্য করেন না নেতারা। সাংগঠনিক বিস্তৃতি নিয়ে তাদের কোনো পরিকল্পনা নেই। ফলে জেলা কমিটির পূর্ণাঙ্গ হয় না আর স্থান পায় না নতুনরা।’
তার কথায় সহমত জানালেন জেলা ছাত্রলীগে স্থান পেতে ইচ্ছুক অপর এক নেতা। খেদোক্তি প্রকাশ করে তিনি বলেন, সংগঠন এবং পদবী যখন টাকা বানানোর মেশিন তখন গতি আসবে না সংগঠনে। এই অবস্থার পরিবর্তন না হলে এ দায় নিতে হবে অভিভাবক সংগঠনকে।
কথায় আগুন ঝড়ালেন সিলেট সরকারি কলেজে পড়ুয়া মহানগর ছাত্রলীগের এক নেতা। তার ভাষায়, ‘টাকার কমিটি টাকার চিন্তাই করবে এবং এটিই স্বাভাবিক। কেন্দ্র ভালো হলে এর প্রভাব জেলায় পড়তে বাধ্য। কেন্দ্র যখন টাকার কাছে বিক্রি হয় তখন জবাবদিহিতার বিষয়টি আর থাকে না। যার প্রভাব সিলেট মহানগরে। অদূরদর্শী নেতৃত্বে সিলেটে ছাত্রলীগ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।’
মহানগর কমিটিতে স্থান পেতে ইচ্ছুক এক ছাত্রলীগ নেতা বলেন, ‘নতুন কমিটি দায়িত্ব পরবর্তী আজ পর্যন্ত খোঁজ নেয়নি অন্তর্ভুক্ত কোনো ইউনিটের দিকে। তাদের দৃষ্টি কেবল উপরের দিকে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের জনপ্রতিনিধিবৃন্দের বিভিন্ন কর্মসূচিতে শো’ডাউন প্রদর্শনের ভূমিকা ছাড়া যেন তাদের আর কোনো কাজ নেই।’
সামগ্রিক বিষয়ে জানতে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাহেল সিরাজকে ফোন করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেন নি। একইভাবে মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি কিশোয়ার জাহান সৌরভের মোবাইল ফোনও বন্ধ পাওয়া যায়।
এসআইএইচ