কুড়িগ্রামে হারিয়ে যাচ্ছে পিঁড়িতে বসে চুল-দাঁড়ি কাটার রীতি
পুরুষ মানুষের চুল-দাঁড়ি অনেক সৌন্দর্য্য বহন করে। চুল-দাঁড়ি কাটার কারণে যুগের পর যুগ ধরে নরসুন্দরদের কদর ও প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। চুল-দাঁড়ি কেটে মানুষকে সুন্দর করাটাই একমাত্র কাজ বলে তাদেরকে নরসুন্দর বলা হয়। এ জন্য নরসুন্দররা মানুষের কাছে নাপিত হিসেবেও পরিচিত। আধুনিক সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের ফলে আজ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের গতিধারায় এসেছে পরিবর্তন, লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। আধুনিক সভ্যতায় গড়ে উঠেছে আধুনিক ও উচ্চ মানের সেলুন। এই সেলুনের কদর দিন দিন বেশি হওয়ায় অনেকেই ঝুঁকছেন হাট-বাজারে কিংবা শহরের বিভিন্ন স্থানে সেই সব সেলুনগুলোর দিকেই। তারপরেও আধুনিক ও স্মাট যুগে এসেও এখনো জেলার বিভিন্ন প্রান্তের হাট-বাজার কিংবা গ্রামগঞ্জের জলচৌকিতে বা ইটের উপর সাজানো পিঁড়িতে বসে চুল-দাঁড়ি কাঁটেন নরসুন্দররা। হাঁটুর নিচে মাথা পেতে আবহমান বাংলার মানুষের চুল-দাঁড়ি কাটার রীতি চলে আসলেও সেই ঐতিহ্যবাহী আদি পরিচিত দৃশ্য এখন আর আগের মতো সচরাচর চোখে পড়ে না। হারিয়ে যাচ্ছে আবহমান কাল ধরে চলে আসা এই গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য।
কুড়িগ্রামের সদর উপজেলার কাঁঠালবাড়ী খোলাবাজারে কড়া রোদের মধ্যে কোনো রকমে রোদ থেকে রক্ষা পেতে ছাতি ব্যবহার করে বসে থাকা চুল-দাঁড়ি কাটানোর চিরচেনা দৃশ্য চোখে পড়ে। পিঁড়িতে বসে অল্প খরচে এখনো তাদের কাছে অনেকেই চুল-দাঁড়ি কাটান।
রাজারহাট উপজেলার ছিনাই ইউনিয়নের বামন পাড়া এলাকার গোপাল চন্দ্র শীল (৭১) ও ছিনাই এলাকার সুধীর চন্দ্র শীল (৭২)। এই দুইজন একে-অপরের সহযোদ্ধা। বংশ পরিক্রমায় হয়েছেন নরসুন্দর। এই সহযোদ্ধা দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে এই পেশায় আছেন। গোপাল চন্দ্র শীলের চার ছেলের কাঁঠালবাড়ী বাজারসহ বিভিন্ন হাট-বাজারে সেলুনের দোকান থাকলেও চার ছেলের আলাদা সংসার থাকায় তিনি এই বৃদ্ধ বয়সে কাঁঠালবাড়ী, ছিনাই, সিঙ্গিমারী বাজারের এককোণে পিঁড়িতে বসে মানুষের চুল-দাঁড়ি কেটে জীবিকা নির্বাহ করেন। একই অবস্থা সুধীর চন্দ্র শীলের। তার একমাত্র ছেলের বাজারে সেলুনের দোকান থাকলেও ছেলের আয়ে জোটে না জীবন-জীবিকা। তাই তিনিও বৃদ্ধ বয়সে গোপাল চন্দ্র শীলের সাথে এক সঙ্গে খোলা আকাশের নিচে বসে মানুষের চুল-দাঁড়ি কাটেন। এভাবেই চলে তাদের জীবন-জীবিকা। তাদের মৃত্যুর পর বাপ-দাদার এই পেশা ধরে রাখার মতো তাদের বংশে এমন কেউ নেই। এই দুই ব্যক্তির কোনো একদিন মৃত্যু হলে এই উপজেলা থেকে হারিয়ে যাবে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী এই চিরচেনা দৃশ্য। এই দুই ব্যক্তি জীবিত থাকায় এখনো হাটে-বাজারে জলচৌকিতে বসে কাঠের বাক্স যার মধ্যে ক্ষুর, কাঁচি, চিরুনি, সাবান, ফিটকিরি, পাউডার ও লোশন নিয়ে প্রতিনিয়ত মানুষকে সুন্দর করে যাচ্ছেন। অনেক বছর আগে চুল কাটা বাবদ দিতে হতো ৪ পয়সা আর দাঁড়ি কাটার জন্য ২ পয়সা। সে সময় যা আয় হতো তা দিয়ে সংসার ভালোভাবেই চলত। কিন্তু বর্তমানে ২০ টাকায় চুল ও ১৫ টাকা দাঁড়ি কেটেও সারাদিন যে টাকা উপার্জন হয় তা দিয়ে সাংসার চালানো তাদের হিমশিম খেতে হয়।
সুধীর চন্দ্র শীল (৭২) ও গোপাল চন্দ্র শীল (৭১) জানান, পূর্বে আমরা বার্ষিক চুক্তিতে কাজ করতাম। কিন্তু বর্তমানে সেই নিয়ম নেই। তারা আক্ষেপ করে বলেন, সেলুনে এখন আর শান দেওয়া ক্ষুর দেখাই যায় না। তার বদলে এসেছে ব্লেড লাগানো ক্ষুর। এখন এসেছে চুল কাটানো মেশিন, শেভিং ক্রিম, লোশন, চুলের কলপ। আমরা যখন বাপ-দাদার কাছে কাজ শিখে নিজেরাই কাজ শুরু করি তখন এগুলো আমাদের কাছে ছিল কল্পনাতীত। ছেলেদের আধুনিক সেলুনের দোকান থাকলেও তাদের সংসারে ঠাই মেলেনি।
তাই এই বৃদ্ধ বয়সে একদিকে বাপ-দাদার পেশাটা ধরে রাখার লড়াই ও অন্যদিকে জীবন-জীবিকার তাগিদে প্রখর রোদ উপেক্ষা করে চুল-দাঁড়ি কাটান তারা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তারা এই লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন বলে জানান এই দুই সহযোদ্ধা।
কাঁঠালবাড়ী এলাকায় কৃষ্ণ চন্দ্র রায় (৭০) বলেন, এখন তো বিভিন্ন হাট-বাজারে অনেক আধুনিক সেলুন আছে। কিন্তু যখনই বাজারে যাই ওই চুল কাটা দেখলে ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায়। কারণ তারা যখন চুল কাটত দুই হাঁটু দিয়ে আমাদের চাপ দিয়ে ধরত যেন নড়াচড়া না করতে পারি। ফলে যখন চুল কাটত তখন তার হাঁটুর উপর ঘুমিয়ে পড়তাম। চিরচেনা দৃশ্য ছোট বেলার স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। তবে আমি এখনও মাঝেমধ্যে মাটিতে বসা নরসুন্দুরদের কাছে চুল-দাঁড়ি কেটে নেই।
ফুলবাড়ী উপজেলার নাওডাঙ্গা স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুল হানিফ সরকার ও রাজারহাট উপজেলার সহকারী শিক্ষক তুষার চন্দ্র রায় বলেন, আমরা ছোট বেলায় বাবার সঙ্গে যেতাম। চুল কাটাতে তাদের দায়িত্ব দিয়ে বাবা বাজারের সব কাজ শেষে আসতেন। এখন আর তাদের কাছে চুল-দাঁড়ি কাটায় না। এখনকার ছেলে-মেয়েদের চুল কাটায় আধুনিক সেলুনগুলোতে। আমরা এখনো এই দৃশ্য নিজের চোখে দেখলেও এমন একটা সময় আসবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে নিছকই গল্প মনে হবে।
এসআইএইচ