ঠাকুরগাঁওয়ে ঈদের আগে গরিবের চাল নিয়ে নয়-ছয়

ঈদের আগে গরিবের ভিজিএফের চাল বিতরণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। জনপ্রতি ১০ কেজির পরিবর্তে ৭-৯ কেজি করে চাল দেওয়া হয়েছে। তবে চাল কম দেওয়ায় চেয়ারম্যানকে বলতে গেলে উল্টো বলেন ফ্রি চাল পাও এতেই বেশি আবার অভিযোগ। এতে ক্ষুদ্ধ ওই ইউনিয়নের সুবিধাভোগীরা। এ ধরনের অভিযোগ উঠেছে সদর উপজেলার দেবীপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে । তার বিরুদ্ধে দরিদ্র-অস্বচ্ছল ব্যক্তিদের চাল না দিয়ে স্বচ্ছল ব্যক্তিদের চাল দেওয়ার অভিযোগও তুলেছেন ভুক্তভোগীরা।
সোমবার (১৭ এপ্রিল) সদরের বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে হত-দরিদ্রদের মাঝে ভিজিএফ’র চাল বিতরণ করা হয়। এ সময় দেবীপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা বৃদ্ধ জয়নুল আবেদীনসহ আরো দুইজন টিপ সই দিয়ে ভিজিএফের ৩০ কেজি একটি খোলা চালের বস্তা নেন। দোকানে ওজন দিয়ে দেখেন চাল ৩০ কেজি নয়, ২৬ কেজি। বাকি চাল উধাও। এ কথা চেয়ারম্যানকে বলতে গেলে চেয়ারম্যান রেগে গিয়ে বলেন ফ্রি চাল পাচ্ছেন এটাই বেশি।
একই ইউনিয়নের তরিকুল ইসলাম সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত অপেক্ষার পর তিনজন মিলে ৩০ কেজি চাল পান। তিনিও বাইরে এক দোকানে চালের বস্তাটি ওজন দিয়ে দেখেন ৩০ কেজি চালের বদলে চাল হচ্ছে ২৭ কেজি। বাকি ৩ কেজি নেই। তরিকুল চেয়ারম্যানকে এ কথা বলতে যাবে এমন সময় রাস্তায় থাকা পরিষদের দুইজন সদস্য থামিয়ে দিয়ে বলেন চেয়ারম্যান অনেক রেগে আছে যা চাল পাইছেন তা নিয়ে চলে যান। পরে সমস্যা হতে পারে।
এ বিষয়ে তরিকুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, প্রায় ২৫ জন চাল ওজন দিল কিন্তু কেউ সঠিকভাবে চাল পাইনি। কেউ পেয়েছে সাত-আট কেজি আবার কেউ ৯ কেজি। কিছু বললেই চেয়ারম্যান রাগ করে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করেন।
অভিযোগ রয়েছে, ওই ইউনিয়নে অস্বচ্ছলদের ভিজিএফের কার্ড না দিয়ে স্বচ্ছলদের কার্ড দিয়ে ভিজিএফের চাল প্রদান করা হয়। স্বচ্ছল ব্যক্তিরা সেই চাল পেয়ে গরিবদের কাছে টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দেয়।
চাল কিনতে আসা এক বৃদ্ধের সাথে কথা হয়। নামপ্রকাশ না করার সত্যে তিনি বলেন, ‘মুই গরিব মানুষ। মুই কোনো চাউনের কার্ড পাওনি। কাহোও মোক কিছু দেনা। আজি শুনিনু বোডড (পরিষদ) নাকি চাউল দিবে। আসেহেনে শুনুনু লোকলা চাউল পাহেনে বিকাছে (বিক্রি)মুইহো মাইছের কাছত ৩০০ টাকা ধার করে ১০ কেজি কিনিনু এলা দেখেছু ৮ কেজি। মোক গরিব লোকটাক ঠকাবা নাগিবে। কি লাভ মোক ঠকাহেনে।’
স্থানীয়রা ক্ষোভ প্রকাশ করে ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, যারা প্রকৃত গরিব তারা যদি চাল না পায় তাহলে ভিজিএফের চাল কারা পাচ্ছে? যারা চাল পাচ্ছে তারা অনেকেই তা বিক্রি করে দিচ্ছে। বস্তা প্রতি আধা কেজি চাল কম মানা যায় কিন্তু চার থেকে পাঁচ কেজি। বাকি চালগুলো কথায় যাচ্ছে? কে খাচ্ছে?। চেয়ারম্যানকে বলতে গেলে তিনি উগ্র ভাষায় বলে যে ফ্রি চাল পাচ্ছে এটাই বেশি আবার অভিযোগ। চেয়ারম্যানের এমন কথায় মনে হচ্ছে তিনি তার নিজের টাকায় কিনে চালগুলো দিচ্ছে।
তারা আরো বলেন, এত অভিযোগ তবুও কোনো ব্যবস্থা নেয় না স্থানীয় প্রশাসন। ইউএনওকে অভিযোগ দিলে তিনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও বাস্তবে তিনি কোনো ব্যবস্থা নেয় না। চেয়ারম্যান নিজের ইচ্ছামতো যাচ্ছেতাইভাবে পরিষদ চালাচ্ছে। শুধু চাল নয়, আরো অসংখ্য অনিয়মের অভিযোগ আছে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে। যারা সত্যিকারে অসহায় দু-একজন ছাড়া বাকিরা কেউ কোনো সুবিধা পাই না বলে অভিযোগ তাদের।
তবে চাল কম দেওয়ার ব্যাপারে চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেনের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি সংবাদকর্মীদের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, চাল কম দিচ্ছি কি দিচ্ছি না এটা আমি বুঝব আর যারা নিচ্ছে তারা বুঝবে। আপনারা কথা বলার কে?। কত সাংবাদিক এলো গেল কেউ কিচ্ছু করতে পারেনি আমার। নিউজ করে কোনো লাভ নেই। কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে তিনি সংবাদকর্মীদের উপর তেরে আসেন।
একই চিত্র সালন্দর ইউনিয়নেও। সেখানে চাল বিতরণের সময় প্রত্যেক কার্ডধারিদের চার থেকে পাঁচ কেজি পর্যন্ত ওজনে কম দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তবে এ বিষয়টি সদর উপজেলার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ পূর্ণবাসন কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর হোসেন জানার পর চাল বিতরণ কার্যক্রম বন্ধ করে দেন। পরে তিনি নিজেই পরিষদে গিয়ে চাল বিতরণ করেন। সালন্দর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলে এলাহী মুকুট চৌধুরী জরুরি কাজে শহরের বাইরে থাকায় প্যানেল চেয়ারম্যান এমনটা করেছে বলেন জানান এই কর্মকর্তা।
অন্যদিকে মঙ্গলবার (১৮ এপ্রিল) সদরের বেগুনবাড়ি ইউনিয়নে চাল বিতরণের সময় সুবিধাভোগীদের হাতে চাল তুলে দেওয়ার পর দরিদ্র কার্ডধারি মানুষগুলোর কাছে বস্তার দাম আদায় করা হয় মাথাপিছু ২০/৩০ টাকা করে। এতে ক্ষুদ্ধ ওই ইউনিয়নের সুবিধাভোগীরা। তবে চেয়ারম্যান বনি আমিন টাকা নেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, কারো কাছ থেকে কোনো টাকা নেওয়া হচ্ছে না। কেউ যদি নিয়ে থাকে তার দায় সেই নিবে।
এ ছাড়াও সোমবার (১৭ এপ্রিল) বিকালে রুহিয়া থানার সবুজ সাথী হাসকিং মিলের গোডাউন থেকে ২৮ বস্তা ভিজিএফের চাল উদ্ধার করেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও আবু তাহের মো. সামসুজ্জামান ও উপজেলার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ পূর্ণবাসন কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর হোসেন।
জানা গেছে, সোমবার ঢোলারহাট ইউনিয়নে দরিদ্রদের মাঝে ভিজিএফের চাল বিতরণ করা হয়। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে খবর পেয়ে সবুজ সাথী হাসকিং মিলে অভিযান চালিয়ে ২৮ বস্তা সরকারি চাল উদ্ধার করে ইউএনও। তবে সবুজ সাথী হাসকিং মিলের মালিক শহিদুল ইসলাম জানায়, ঢোলারহাট ইউনিয়নের কৃষ্ণ রায় ও দীনেশ চন্দ্রের কাছ থেকে তিনি চালগুলো ক্রয় করেন।
এ বিষয়ে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকতা আবু তাহের মো. সামসুজ্জামান জানান, কোনো ইউনিয়নে ভিজিএফের চাল বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর রুহিয়ায় হাসকিং মিল থেকে যে চালগুলো উদ্ধার করা হয়েছে তা তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এসআইএইচ
