লাগামহীন মূল্য বৃদ্ধিতে খেটে খাওয়া মানুষের নাভিশ্বাস
চলছে সিয়াম সাধনার মাস পবিত্র মাহে রমজান। এ সময় সবারই মন চায় সারাদিন রোজা রেখে রাতে একটু ভালো-মন্দ খেতে। কিন্তু মানুষের উপর চেপে বসেছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ঘোটক। প্রতিনিয়ত সে বাজারের রশি টানছে। এমতাবস্থায় সাধারণ মানুষ এখন মহা ভাবনায় হাবুডুবু খাচ্ছে। প্রতিটি জিনিসের দাম আকাশচুম্বী। আগের তুলনায় দ্রব্যের মূল্য কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সব মিলিয়ে কাঁচাবাজারের লাগামহীন মূল্যে নিম্ন আর মধ্যম আয়ের মানুষের জীবন এখন বিপর্যস্ত। বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। সবজি কেনাও এখন দুরূহ ব্যাপার।
পেটের চাহিদা মেটাতে প্রতিদিন বাজারে গিয়ে হাত পুড়ছে মানুষের। তাপময় বাজার আর ঠাকুরগাঁও জেলার সাধারণ মানুষ কীভাবে চলছে সেই খোঁজ নিতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে গেলে সবারই একই কথা লাগামহীন ঘোটক লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ায় হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে আমাদের ক্রয়ক্ষমতা।
কথা হয় আকচা ইউনিয়নের বাসিন্দা তরিকুলের ইসলামের সঙ্গে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে কেমন করে চলছে তার সংসার জানতে চেয়েছিলাম। দীর্ঘ আলোচনায় উঠে আসে তার চলমান সময়ের সব কথা। দেবীগঞ্জ বাজারে ছোট একটি পানের দোকান নিয়ে বসেন তিনি। তার উপর ভর করেই চলে সংসার। নিজস্ব তেমন জমি-জায়গা নেই। ফলে পান-সিগারেট বিক্রি করেই বাজার কিনতে হয় তাকে। সংসারের অন্যান্য খরচও চালাতে হয় পান বেঁচেই। দিনের বেলায় বেচা-কেনা কম হলেও সন্ধ্যায় একটু বেশি হয়। গত কয়েক মাসে বাজারের টালমাটাল অবস্থায় অনেকটা দিশাহারা। সব কিছুর দাম নাগালের বাইরে। কোথাও সহজে হাত দিতে পারছেন না তিনি। তারপরও সংসারের যাবতীয় খরচ জোগাড় করতে হচ্ছে। বাজারের তাপে তিনি অনেকটা ঝলছে গেছেন বলে ঢাকাপ্রকাশ-কে জানান তরিকুল।
জিনিসের অগ্নিমূল্য নিয়ে কথা হয় ঠাকুরগাঁওয়ের রানীংশকৈল উপজেলার সাংবাদিক নাজমুলে সঙ্গেও। চলমান বাজার পরিস্থিতি এবং সাধারণ মানুষের আয় এই দুইয়ের সমন্বয় কীভাবে করছে মানুষ? এক কথায় উত্তর দিয়ে তিনি ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। মানুষের আয় মোটেও বাড়েনি। বিশেষ করে গ্রামের মানুষের নির্ধারিত কোনো আয়ও নেই। জমির ফসলের উপর নির্ভর করে তারা। ফসল ভালো হলেও অনেক সময় ন্যায্য দাম পায় না কৃষকরা। তাই কম দামে বিক্রি করে দেয় তাদের কষ্টের ফসল। এখন প্রায় সব নিত্যপণ্যের দাম আকাশ ছোঁয়া। অতিরিক্ত দামের কাছে গ্রামের মানুষরা কাবু হয়ে পড়েছে। সব মানুষের ক্ষমতা নেই সব জিনিস ক্রয়ের।
তিনি মনে করেন, বর্তমান দেশের বাজার পরিস্থিতি একেবারেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ব্যবসায়ীরা লোক বুঝে একেকজনের কাছে একেক রকম দামে পণ্য বিক্রি করছেন। এতে একেবারেই খেটে-খাওয়া শ্রেণির মানুষ চরম বিপাকে পড়েছেন। সেই সঙ্গে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ চরম হতাশায় ভুগছেন। বাজার পরিস্থিতি এ রকম থাকলে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়বে।
ডিমের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে এক ব্যবসায়ী জানান, একদিকে মুরগির খাবারের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে অন্যদিকে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ডিমের দাম বাড়ানো হয়েছে।
সাধারণ মানুষের পাশাপাশি চাকরিজীবীরাও বাজারের এমন টালমাটাল পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। পরিবারের চাহিদা পূরণে প্রতিনিয়ত শরীর থেকে ঘাম ঝড়াছেন। দিন যত যাচ্ছে ততই দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক গতি বাড়ছে। চলমান বাজার পরিস্থিতি নিয়ে ঢাকাপ্রকাশের কাছে কষ্ট আর হতাশার কথা জানান বেসরকারি কলেজের কয়েকজন শিক্ষক।
শিক্ষকরা বলেন, অন্য যেকোনো চাকরিজীবীর তুলনায় শিক্ষকদের বেতন কম। মাসের অর্ধেক না যেতেই বেতনের টাকা শেষ হয়ে যায়। সারা মাস বিভিন্ন দোকানে বাকিতে জিনিস কিনে সংসার চালাতে হয়। সময় মতো দোকানিদের টাকা দিতে না পারলে বাকি দেওয়া বন্ধ করে দেয়। বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে নাভিশ্বাস উঠেছে বেসরকারী শিক্ষক সমাজের। শিক্ষকরা মনে করেন এ রকম চলতে থাকলে শিক্ষকদের সবকিছু ছেড়ে মাঠে গিয়ে কাজ করতে হবে। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
এদিকে সরকার ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পণ্য কম দামে দেওয়া শুরু করেছে। সেই পণ্য চাহিদার তুলনায় একেবারেই নগণ্য। টিসিবির পণ্য কিনতে আসাদের লম্বা লাইন দেখলে সহজেই অনুমান করা যায় চলমান পরিস্থিতিকে। অনেক মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ লজ্জা লুকিয়ে টিসিবির পণ্য ক্রয়ের লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকছেন।
তবে মানুষ এখন নিরুপায়। কারণ পাঁচ টাকার শাক বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকায়। করলার কেজি ৮০ টাকা, পটোলের কেজি ৭০ টাকা, আলুর কেজি ২৫-৩০ টাকা। ডিমের হালি ৪৫-৪৮ টাকা। বেড়েছে পেস্ট, শ্যাম্পু, সাবান, মাথার তেলের দামও।
এ বিষয়ে সবজি ব্যবসায়ী কাউসার বলেন, দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতারা যেমন ক্ষীপ্ত তেমনি আমরাও বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছি। সাধারণ মানুষ বাজারে এসে দাম শুনে প্রয়োজনীয় অনেক কিছু না কিনে চলে যাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ বেশি দামে কিনতে বাধ্য হচ্ছেন।
খুচরা বিক্রেতা দুলাল বলেন, পণ্যের দাম একবার বাড়লে তা সহজে কমে না। শীতের সবজি শেষের দিকে। ফলে দাম বাড়ছে। আরেক বিক্রেতা বলেন, যেসব সবজির মৌসুম শেষ সেসব সবজির দাম কিছুটা বেশি। কারণ ওইসব সবজির সরবরাহ কমে গেছে।
তবে বাজার ঘুরে অধিকাংশ দোকানে দেখা মেলেনি নির্দিষ্ট মূল্য তালিকার। এর ফলে একেক বাজারে একেক রকম দাম হাঁকাচ্ছেন বিক্রেতারা।
এ ব্যাপারে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার ঠাকুরগাঁও জেলার সহকারী পরিচালক মো. শেখ সাদী বলেন, রমজান মাসে যাতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি না হয় সেই অনুযায়ী বাজারগুলো মনিটরিং করা হচ্ছে।
এসআইএইচ