রংপুরে নিম্ন আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে তরমুজ
আসন্ন মাহে রমজানের সুযোগ কাজে লাগিয়ে মৌসুমের শুরুতে রংপুরের বাজারগুলোতে নিয়ম ভেঙে কেজি মাপে তরমুজ বিক্রি করছেন খুচরা বিক্রেতারা। যে পদ্ধতিতে ক্রয় সেই নিয়মে পণ্য বিক্রির বিধান রয়েছে ভোক্তা অধিকার আইনে। কৃষক থেকে পাইকাররা পিস হিসেবে তরমুজ কেনেন। কিন্তু বেশি লাভের আশায় খুচরা বাজারে অন্যায়ভাবে সেই তরমুজ কয়েকগুণ বেশি দামে কেজি দরে বিক্রি করা হচ্ছে । ফলে রংপুরের সাধারণ নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয় ক্ষমতার নাগালের বাইরে চলে গেছে মৌসুমী এই ফল। এদিকে দরজায় কড়া নাড়ছে আত্মসংযমের মাস পবিত্র মাহে রমজান। রমজানে রোজাদারদের ইফতারে বেশি চাহিদা থাকে শরবতসহ রসালো ফলের। বাংলার চৈত্র আর বৈশাখ মাসের মধ্যবর্তী সময়ে এবারের রমজান। এই গরম আবহাওয়ায় তরমুজের চাহিদা বেশি থাকে। সেই চাহিদাকে কাজে লাগিয়ে তরমুজ বিক্রির খুচরা পর্যায়ে চলে নানা কারসাজি।
বরিশাল অঞ্চলের কৃষক-পাইকার আর রংপুর অঞ্চলের খুচরা বাজারগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ৮ থেকে ১০ কেজি ওজনের একটি তরমুজ বর্তমানে রংপুর নগরীতে বিক্রি করা হচ্ছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায়। অথচ পাইকারি বাজারে এই সাইজের তরমুজের দাম সর্বোচ্চ ১৯০ থেকে ২১০ টাকা। উৎপাদক পর্যায়ে গেলে তা আরও কম। পুরো বিষয়টিকে খুচরা বিক্রেতাদের কারসাজি বলছেন পাইকার আর ক্রেতারা। গত দুই থেকে তিন বছর ধরে ভোক্তা অধিকার আর ভ্রাম্যমাণ আদালতের চোখ ফাঁকি দিয়ে এই পদ্ধতিতে তরমুজ বিক্রি চলছে রংপুরে। কিভাবে এই সিন্ডিকেট তৈরি হলো তার উত্তর মিলছে না। মাঝখান থেকে দেশে উৎপাদিত এই সুমিষ্ট ফলটির স্বাদ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
গত বছর বিশেষ করে রমজান মাসে কয়েক দফায় কেজি দরে দ্বিগুণ দামে তরমুজ বিক্রির ঘটনায় অভিযান পরিচালনা করে রংপুরের ভোক্তা অধিকার ও জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত। ফলে গত বছর সর্বশেষ আকারভেদে ৫০ থেকে ১০০ টাকা দরে তরমুজ বিক্রি হয়েছিল। এবার মৌসুমের শুরুতেই বরিশাল অঞ্চলের তরমুজে সয়লাব হয়েছে রংপুরের ফলের বাজারগুলো। এখন পর্যন্ত মৌসুমী এই ফল বিক্রিতে কারসাজি রোধে কর্তৃপক্ষের বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা চোখে পড়েনি।
বৃহস্পতিবার বিকালে রংপুর নগরীর সিটি বজার, মেডিকেল মোড়, সাতমাথা বাসস্ট্যান্ড এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, দক্ষিণাঞ্চলের সবুজ আর কালো তরমুজে সয়লাব হয়েছে। বিক্রেতারা এই তপ্ত গরমে হাঁকডাকে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করছেন। কেউ আবার তরমুজের মাঝখানে চাকু দিয়ে লাল টকটকে একচিলতে ফলা উল্টিয়ে সাজিয়ে রেখেছেন ক্রেতাদের বিশ্বাস স্থাপনে।
রংপর নগরীর সিটি বাজারের সামনে তরমুজ বিক্রেতা রিপন মিয়া সারি সারি করে সাজিয়ে রেখেছেন সবুজ আর কালো তরমুজ। ক্রেতারা আসছেন আর তরমুজের দাম জিজ্ঞেস করছেন। রিপন মিয়ার চাওয়া ৫০ টাকা কেজি দরের কথা শুনে চলে যাচ্ছেন সাধারণ ক্রেতারা। এই আধা ঘণ্টায় রাজা মিয়ার দোকানে ৫- ৮ কেজি ওজনের তরমুজ বিক্রি হয়েছে ৫টি। এই ৫টি তরমুজ যারা কিনেছেন তাদের মধ্যে চোখে পড়েনি একজন সাধারণ নিম্ন আয়ের মানুষকেও।
রিপন মিয়ার দোকান থেকে ৭ কেজি ওজনের একটি তরমুজ কিনেন সামসুজ্জামান নামের এক চাকরিজীবী । তিনি বলেন, ‘বছরের শুরুতে তরমুজ বাজারে এসেছে শুনে স্কুল পড়ুয়া ছেলে-মেয়েরা বায়না ধরেছে, তাই কিনে নিয়ে যাচ্ছি। সন্তানদের আবদার পূরণে কিনলাম।
আখতারুজ্জামান নামের এক অটোচালক বলেন, কয়েক দিন থেকে বাজারে তরমুজ দেখছি। কেনার ইচ্ছা মনে মনে পোষণ করেছি। কারণ আমার সন্তানরা তরমুজ খুব পছন্দ করে। দাম শুনে কেনার ইচ্ছে মরে গেছে।
তিনি আরও বলেন, তরমুজের সাইজ এবং দাম অনুযায়ী একেকটা ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। সারাদিন অটো চালিয়ে এ পরিমাণ আয় হয়। একটা তরমুজ কিনলে দিনের বাজার সদাই একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে, তাই নেওয়া হলো না।
তার মতো অনেক নিম্ন আয়ের মানুষ তরমুজ কিনতে এসে ক্ষুব্ধ হচেছন বিক্রেতার উপর। অনেকে কেজি দরে নয় প্রতি পিস হিসেবে কিনতে তরমুজ বিক্রেতার সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ছেন । ক্ষুব্ধ ক্রেতারা বলছেন, রমজানের আগে যেভাবে কেজি দরে বিক্রি শুরু হয়েছে। রমজান মাসে এই তরমুজের দাম কোন জায়গায় গিয়ে পৌঁছায়। তারা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে কঠোর নজরদারির দাবি জানান।
বরিশাল অঞ্চল থেকে পিস হিসেবে পাইকারি দরে তরমুজ কিনে এনে রংপুর বিভাগের বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করা হাফেজ উদ্দিন নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, বরিশাল, ভোলা,পটুয়াখালীতে এখন তরমুজের মৌসুম শুরু হয়েছে। গত এক সপ্তাহ আমি সেখান থেকে তরমুজ কিনে এনে বিভাগের বিভিন্ন এলাকায় পিস হিসেবে পাইকারি বিক্রি করেছি ।খুচরা ব্যবসায়ীরা কেজি দরে বিক্রি করে।
দামের বিষয়ে তিনি বলেন, ৮ থেকে ১২ কেজি ওজনের বড় সাইজের তরমুজ পাইকারি হিসেবে প্রতি ১০০ পিস ১৮ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে । ৭ থেকে ৫ কেজি ওজনের তরমুজ ১০০ পিস পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ৫-৬ হাজার টাকায়। ২ থেকে ৪ কেজি ওজনের ৩ থেকে ৪ হাজার টাকায় ১০০ পিস।
এ ব্যাপারে রংপুর ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আফসানা পারভীন বলেন, বিক্রির পদ্ধতি সম্পর্কে আইনে কিছু বলা না থাকলেও পাইকারি দরের চেয়ে খুচরা বাজারের দরে কতটা পার্থক্য থাকতে পারে তা স্পষ্ট বলা আছে। তরমুজের ক্ষেত্রে যা হচ্ছে তা বেআইনি। রংপুরে তরমুজ বিক্রির বিষয়ে আমরা বাজার মনিটরিং করব।
এসআইএইচ