‘কয়দিন পর তো না খায়হানে মরিবা হবে’
রমজান আসতে আর এক মাসও বাকি নেই। তার আগেই নিত্যপণ্যের বাজার হয়ে উঠেছে উত্তপ্ত। চাহিদা অনুযায়ী বাজার করা যাবে কি না সেজন্য পণ্য কেনার আগে বার বার পকেটে হাত দিয়ে চেক করছেন ক্রেতারা। অনেকেই প্রয়োজনীয় পণ্য না কিনেই ফিরে যাচ্ছেন বাড়িতে। চাল, ডাল, ডিম, মাছ, মাংসসহ সবকিছুই মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। বাসা ভাড়া, চিকিৎসা ও যাতায়াত ব্যয় বেড়েছে। নিত্যপণ্যের দাম বাড়লেও আয় তেমন বাড়েনি। ফলে বর্তমানের সর্বনিম্ন মজুরি দিয়ে একজন শ্রমিকের জীবনযাপন সম্ভব হচ্ছে না।
বাজারের গিয়ে দেখা যায়, সাত দিনের ব্যবধানে প্রতি কেজি মোটা চালের দাম বেড়েছে দেড় থেকে দুই টাকা। শীত শেষ হওয়ায় মৌসুমি সবজিও বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে। তেলাপিয়া-পাঙাশের মতো চাষের মাছের কেজিও হয়েছে ২০০ থেকে ২২০ টাকা। কয়েক দিন থেকে অস্থির ব্রয়লার ও ডিমের দাম। বেড়ে যাচ্ছে দফায় দফায়। বর্তমানে ২৪০ টাকা কেজির এসব মুরগির দাম সপ্তাহখানেক আগে ছিল ২২০ টাকা। আর এক মাস আগে বিক্রি হতো ১৬০ টাকা কেজি। একইভাবে ডিমের দাম মাসের ব্যবধানে হালিতে প্রায় ১০-১২ টাকা বেড়ে হয়েছে ৪৫-৪৮ টাকা। অন্যদিকে রমজানের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ পণ্য হলো ছোলা বা বুট। আর বাজারে সেই ছোলা এখনই কেজি ৯০-৯৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে, যা এক থেকে দেড় মাস আগেও ছিল ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। লেবুর হালি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়। বেড়েছে আমদানি করা সব ধরনের ফলের দামও। ডিম, মসলা ও মাছ-মাংসসহ প্রায় সব ধরনের ভোগ্যপণ্যেরই দাম বেড়েছে।
রমজানের আগে দাম কমার কোনো লক্ষণ নেই বলে জানান বাজারের বিক্রেতারা। তারা ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, বেশি দামে কিনতে হয়, এ কারণে আমাদের কিছু করার নেই। দাম বেড়ে যাওয়ায় আমাদের বিক্রি কমে গেছে প্রায় অর্ধেক। বেশি দাম থাকলে তো মানুষ কিনতে চাইবে না।
কথা হয় ঠাকুরগাঁও সদরের নারগুন ইউনিয়নের এক নারী শ্রমিক অমেলা রানীর সঙ্গে। তিনি জানান, সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত তিনি ফুলবাগান পরিচর্যা করেন। দিন শেষে মজুরি পান ২০০ টাকা। তাও আবার দুপুরে নিজেকেই খেতে হয়। বাড়িতে অসুস্থ স্বামী আর চার কন্যার সংসার তার কাঁধেই। ২০০ টাকা দিয়ে তার সংসার চালানো সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিদিন স্বামীর জন্য ওষুধ কিনতে হয় তাকে। প্রায় দিন তিনি না খেয়ে কাজে যান। ২০০ টাকার মজুরিতে চাল-ডাল কিনতেই চলে যায় ১৫০ টাকা। বাকি টাকায় স্বামীর ওষুধ।
পাশেই আরেক নারী শ্রমিক প্রতিমা বলেন, ‘সারাদিন ফুলের গাছ পরিচর্যা করেহেনে ২০০ টাকা পাই। ২০০ টাকা দেহেনে কী আর সংসার চলে। যে হারে জিনিসের দাম বাড়িছে। কয়দিন পর তো না খায়হানে মরিবা হবে।’
গোধূলি বাজারে কথা হয় রমজান আলীর সঙ্গে। তিনি ঢাকাপ্রকাশ-কে জানান, এক বছরে নিত্যপণ্যের প্রায় জিনিসের দামই দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু মানুষের আয়-রোজগার বাড়েনি। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী দামে পকেট খালি হয়ে যাচ্ছে। তাহলে সাধারণ মানুষ কীভাবে বাঁচবে। আরেক ক্রেতা হাসান খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বাজারে এক সপ্তাহের ব্যবধানে সব পণ্যের দামই লাফিয়ে বেড়ে যায়। কিন্তু মানুষের মূল্য বাড়ে না। স্ত্রী, দুই সন্তান নিয়ে এই শহরে তার জীবন ভালো কাটছে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। ফলে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় মাছ ও মাংস খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে তার পরিবার।
খুচরা বিক্রেতা ওসমান গনি বলেন, পণ্যের দাম একবার বাড়লে তা সহজে কমে না। শীতের সবজি শেষের দিকে। ফলে দাম বাড়ছে। আরেক বিক্রেতা বলেন, যেসব সবজির মৌসুম শেষ সেসব সবজির দাম কিছুটা বেশি। কারণ ওইসব সবজির সরবরাহ কমে গেছে।
ভ্যানচালক মুনসুর মিয়া ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘জিনিসপাতির যা দাম, হামরা কী খায় বাচিমো। দাম বেশি হওয়ায় কোনো কিছুই কিনতে পারছি না। খামো কী, মোটা চালের দামও বেড়েছে। কোরবানির ঈদের পর গরুর গোস্ত কোন দিন খায়ছি মনে নাই। আত্মীয় আসলে কষ্ট করে মুরগি দিয়ে চালাতে হয়। তা ছাড়া এলা তো আর আগের মতো কামাই-রুজি নাই।’
মিজানুর রহমান একজন বেসরকারি চাকরিজীবী। তিনি সেনুয়া বাজারে দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে এসেছেন বাজার করতে। মিজানুর বলেন, মাসে ১৮ হাজার টাকা বেতন পাই। দুই বছরে বেতন বাড়েনি এক টাকাও। অথচ বাজারে এসে খালি হাতে ফিরে যেতে হয়। দুই মেয়ের পড়াশোনার খরচ দিতেও হিমশিম খেতে হয়। আমার না খেয়ে থাকতে পারি কিন্তু বাচ্চারা মাছ, মাংস, ডিম ছাড়া খেতে চায় না। তাদের কীভাবে বুঝাব- আমি আর সামলাতে পারছি না।
জাতীয় ভোক্তা-অধিকার ঠাকুরগাঁও জেলার সহকারী পরিচালক মো. শেখ সাদী বলেন, ‘প্রতিদিনই আমরা বাজার তদারক করছি। অনিয়ম পেলে শাস্তিও দেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কাউকেই ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। বাজারে পণ্যের দাম সহনীয় রাখতে আমাদের কাজ চলমান রয়েছে।’
এসএন