মনের আশা পূরণে গোরক্ষনাথ মন্দিরের কূপে মানুষের ঢল
নেকমরদ ইউনিয়নে অবস্থিত অন্যতম পুরাকীর্তি গোরক্ষনাথ মন্দির। আর এই মন্দিরের ভিতরে অবস্থিত কূপটি অলৌকিকভাবে বেলে পাথর দিয়ে তৈরি হয়েছে বলে দাবি স্থানীয়দের। প্রায় ১ হাজার ১০৩ বছরের পুরোনো এই মন্দিরের কূপের পানি হিন্দু সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে মহাপবিত্র। এ ছাড়াও প্রতি বছরের ফাল্গুন মাসে শিব চতুর্দশী তিথীতে পূণ্য স্নানের জন্য এই মন্দিরে আগমন ঘটে অসংখ্য পূণ্যার্থীর। কারণ অনেকের ধারণা, এই কূপের পানি দিয়ে গোসল করলে মনের আশা পূরণ হবে।
জানা যায়, গুপ্ত যুগ থেকে সেন যুগের মধ্যে অর্থাৎ ৯২০ খ্রিস্টাব্দের সময় এই কূপ ও মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল। নাথ সহজিয়ার মতে গুরু গোরাক্ষ নাথের নামানুসারে কুপের এবং স্থানের নামকরণ করা হয়েছে গোরকই। আর এই ‘গরকই’ ফরিকি স্নান বা বারুনীর মেলা হিসেবে আজও সমানভাবে সমাদৃত। প্রতি বছরে এই কূপে স্নান করতে ও শিব চতুর্দশী তিথীতে পূঁজা উপলক্ষে মেলায় বিভিন্ন জেলার নানা বয়সী লাখ লাখ নারী-পুরুষের সমাগম হয়।
ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার নেকমরদ থেকে ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত ‘গোরকই’ নামক স্থানে গোরক্ষনাথ মন্দির। এখানে গোরক্ষনাথ মন্দির ছাড়াও আছে নাথ আশ্রম। গোরক্ষনাথ মন্দির স্থানীয়ভাবে গোরকই মন্দির নামেও পরিচিত। মন্দির চত্বরে আছে আরও ৫টি মন্দির। এ ছাড়াও আছে ৩টি শিব মন্দির ও ১টি কালি মন্দির। নাথ মন্দিরটি চত্বরের ঠিক মাঝখানে অবস্থিত। মন্দিরের পেছনে রয়েছে কূপটি। পাথর দিয়ে তৈরি একটি ছোট চৌবাচ্চার মাঝে নীচু স্থানে ওই কূপটি অবস্থিত। কূপটি বড় বড় কালো পাথরের খন্ড দ্বারা নির্মিত। এ কূপের একেবারে নীচু অংশটুকু পর্যন্ত পাথর দিয়ে বাঁধানো। উত্তরাঞ্চলের লাখ লাখ সনাতন ধর্মাবলম্বী নারী-পুরুষেরা পাপ-মোচনের জন্য এই কূপের পানিতে স্নান করার উদ্দেশে এখানে আসেন। কূপটির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো-কূপের পানি দিয়ে লাখ লাখ মানুষ স্নান করলেও কূপের এক ইঞ্চি পানি কমে না।
মন্দিরের উত্তরে আছে একটি পান্থশালা। পান্থশালার দরজায় একটি ফলক বা গ্রানাইট শিলালিপি ছিল, যা বর্তমানে ঢাকা জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।
আরো জানা গেছে, গোরক্ষনাথ ছিলেন নাথ পন্থীদের ধর্মীয় নেতা খীননাথের শিষ্য। নবম-দশম শতাব্দির মধ্য ভাগে গোরক্ষনাথের আবির্ভাব ঘটে। তিনি ধর্ম প্রচারের উদ্দেশে এখানে মন্দির স্থাপন করেন। অলৌকিক ওই কূপটি সেই সময়ে নির্মিত বলে প্রবীণদের ধারনা। আবার অনেকের মতে, গোরক্ষনাথ কোনো ব্যক্তির নাম নন, এটি একটি উপাধি মাত্র। গোরক্ষনাথ অথবা উপাধি চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য এই মন্দির ও আশ্রম নির্মাণ করা হয়।
স্থানীয় নারায়নপুর গ্রামের রাম চন্দ্র বর্মন নামে এক দর্শনার্থী বলেন, ‘এই মেলা এখানে প্রতি বছর করা হয়। মেলায় অনেক দূর-দূরান্ত থেকে অনেক মানুষ আসেন। যারা এখানে আসেন তারা মূলত মনবাসনা নিয়ে আসেন। যেমন কারও সন্তান না হলেও এখানে এসে প্রথমে এই কূপে স্নান করে শিব মন্দিরে পূঁজা করলে অনেকের সেই মনবাসনা পূরণ হয়। গঙ্গার জল আমাদের ধর্মে যেমন পবিত্র তেমনি এই কূপের পানিও আমাদের কাছে পবিত্র। তাই এই পানি দিয়ে আমরা গোসল করি। কেউ আবার শুদ্ধিকরণের জন্য শরীরে পানি ছিটিয়ে দেয়।’
বীরেন্দ্র নাথ বর্মন নামে এক প্রবীণ ব্যাক্তি বলেন, ‘এই মন্দির ও কূপটি কে তৈরি করেছে তা আমাদের জানা নেই। তবে আমরা আমাদের পূর্ব পুরুষদের কাছ থেকে শুনেছি যে এই কূপটি নাকি অলৌকিকভাবে নির্মিত হয়েছে।,
দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ উপজেলা থেকে আসা কুশলা গৌস্বামী নামে এক বৃদ্ধা বলেন, এখানে এসে কূপটিতে স্নান করে মন্দিরে পূঁজা করেছি, যাতে আমার মনোবাসনা পূরণ হয়।
সদর উপজেলার জামালপুর ইউনিয়ন থেকে আগত সোহাগী রাণী নামে এক গৃহবধু বলেন, মানুষের মুখে শুনে এখানে এসেছি। এসে অনেক কিছু দেখলাম ও মেলা থেকে অনেক কিছু কিনেছি। এখানে অনেক মানুষের সমাগম হয়েছে।
মেলা আয়োজক কমিটি ও মন্দিরের সাধারণ সম্পাদক অনন্ত কুমার বর্মন জানান, ‘১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে এই মেলা আমরা স্থানীয়দের সহযোগিতায় করে আসছি। আশা করছি এবার ৫ দিনের মেলায় অন্তত ৯ লাখ মানুষের সমাগম হবে।’
মেলা আয়োজক কমিটি ও মন্দিরের সভাপতি কাশীনাথ বর্মন বলেন, ‘আমি শুনেছি ৯২০ খ্রিস্টাব্দে সিন্ধু দেশ থেকে এই গোরক্ষনাথ ও তার বন্ধু নাসির উদ্দিন নামে দুইজন এখানে আসেন। গোরক্ষনাথ এখানে বসবাস শুরু করেন ও নেকমরদে নাসির উদ্দিন। তখনই এখানে অলৌকিকভাবে মন্দির ও কূপটি নির্মিত হয়। তবে কিছু মন্দির আমরা সংষ্কার করে নির্মাণ করেছি। এই কূপটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো লাখ লাখ মানুষ এখানে গোসল করলেও এর পানি কমেও না আবার বাড়েও না।’
তিনি আরও বলেন, ‘চট্টগ্রামের সীতাকন্ডু মেলার সঙ্গে মিল রেখে আমরাও এখানে গোরক্ষনাথ শিব রাত্রীব্রত মেলা করে আসছি। শিবরাত্রীবত্র করলে ও কূপে স্নান করলে আমাদের মনকামনা এবং আশা পূরণ হয় তাছাড়া পাপও মোচন হয়। এই এলাকার মানুষ দরিদ্র হওয়ায় আমরা মন্দিরের ও কূপের সংস্কার করতে পারছি না। তাই মন্দির ও কূপটিকে সংস্কার করার জন্য সরকারকে দাবি জানাচ্ছি ও অনুরোধ করছি। সেইসঙ্গে এই মেলাটিকে ব্যাপক পরিসরে করতে আমাদের সহযোগিতা করার জন্য।
শুক্রবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) সরেজমিনে গোরক্ষনাথ মন্দির ঘুরে দেখা যায়, মেলা উপলক্ষে প্রায় শতাধিক বিভিন্ন ধরণের মালা, শাখা-সিদুর, খেলনা ও মুখরোচক খাবারের দোকান বসেছে। এ ছাড়াও শিশু-কিশোরদের জন্য রয়েছে নাগর দোলনা। মেলায় দোকান দিয়ে অনেকের বাড়তি আয়ের সুযোগও হয়েছে।
রাতিয়া নামে এক দোকানদার বলেন, প্রতিদিন অনেক মানুষের সমাগম হওয়ায় এখানে বেচা-বিক্রি ভালোই হচ্ছে।
এসআইএইচ