দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সরকারি ভাতাভোগীদের নাভিশ্বাস
জীবনের একমাত্র সম্বল এখন দীর্ঘশ্বাস! এর জন্য কোনো টাকাপয়সা লাগে না! তাই জীবন চালানোর চিন্তা করলে শুধু দীর্ঘশ্বাসই পড়ছে বয়স্কভাতা, প্রতিবন্ধীভাতা, বিধবাভাতাসহ সরকারি নানা ভাতাভোগীদের। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে তাদের এখন করুণ অবস্থা। শুধু ভাতার টাকায় জীবন না চলায় প্রতিবন্ধীদের কেউ কেউ মাসের শেষ কটা দিন চলছেন ভিক্ষাবৃত্তি করে।
শারিরীক প্রতিবন্ধী হাবিবুর রহমান (৫৮) ছেঁড়া একখানা লুঙ্গি পরে কোনোরকমে বসে আছেন মলিন মুখে। তিনি কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের গজেরকুটি গ্রামের বাসিন্দা। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলছিলেন তিনি। হাবিবুর বলেন, ‘সরকারের কাছ থেকে যে টাকা পাই তা দিয়ে পেটের ভাতটুকুই জুটছে না, গায়ের কাপড় কিনব কী দিয়ে?’
তিনি জানান, খাদ্যদ্রব্য থেকে শুরু করে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের যে দাম, তাতে তাদের ক্রয়ক্ষমতা একেবারেই তলানিতে ঠেকেছে। একবছর ধরে এক পোশাকই পরছেন। তার হাঁটাচলা স্বাভাবিক নয়। লাঠি ভর দিয়ে কোনো রকমেই চলাচল করেন। অন্য কোনো কাজ করে যে সামান্য কিছু আয় করবেন, তাও পারেন না। পেটের ক্ষুধা মেটাতে যিনি হিমশিম খাচ্ছেন, নতুন পোশাক তার কাছে তো শুধুই স্বপ্ন।
হাবিবুর রহমান জানান, বাজারে চাল-ডাল, শাক-সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জীবন-জীবিকায় নেমে এসেছে চরম অস্থিরতা। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন তার মতো নিম্নআয়ের মানুষজন। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সরকারি সুযোগ-সুবিধা পেলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। মাসিক ৫০০ থেকে ৭৫০ টাকার এ সরকারি ভাতায় কোনো প্রয়োজনই মিটছে না তাদের। এখন দু’মুঠো অন্ন যোগাড় কষ্টের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শারিরীক প্রতিবন্ধী হাবিবুর রহমান অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলেন, সরকারি ভাতাভুক্ত হতে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে তাকে। দীর্ঘদিন ঘুরতে হয়েছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধির পেছনে। শারিরীক প্রতিবন্ধী দুই মেয়ের ক্ষেত্রেও পোহাতে হয়েছে একই যন্ত্রণা। এখন তিনজনের প্রতিবন্ধী ভাতার টাকায় চলে তার ৫ সদস্যের সংসার। শুধুমাত্র ভাতার টাকা দিয়ে জীবন-সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে তার কাছে। নিজের অসুস্থতা ও শারিরীক প্রতিবন্ধী দুই মেয়ের ভরণপোষণে চলে যায় এর সিংহভাগ। আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় করোনাকালে বন্ধ হয়ে গেছে একমাত্র ছেলেসহ দুই মেয়ের পড়ালেখা।
শুধু হাবিবুরই নয়, এরকম অনেকেই আছেন যারা শুধুমাত্র বয়স্ক, বিধবা কিংবা প্রতিবন্ধী ভাতার উপর নির্ভরশীল। সুবিধাভোগীর তালিকায় নাম লেখাতেও অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে তাদের। ভাতভোগীদের অধিকাংশের অবস্থা এমনই। নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় কোনোদিন তাদের খাবার জোটে আর কোনোদিন কাটে উপোস করে। চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করেছেন এসব মানুষ।
বিধবা ভাতাভোগী উপজেলার শিমুলবাড়ী ইউনিয়নের তালুক শিমুলবাড়ী গ্রামের সুখ জাদী। তিন বছর আগে মারা যান স্বামী হ্যাসপেসু মিয়া। স্বামীর রেখে যাওয়া ৪ শতক জমির ভিটাটুকুও বারোমাসিয়া নদীর ভাঙনে বিলীন হয়ে যায়। ওই গ্রামের শাহালম মিয়ার বাড়ির পেছনে একটি টিনের চালা তুলে মেয়ে মরিয়মসহ বসবাস শুরু করেন। পায়ে গোদরোগ থাকায় কেউ কাজে নিতে চায় না তাকে। অনেক চেষ্টার পর বিধবা ভাতা ভোগীর তালিকায় নাম ওঠে তার। বর্তমানে নিত্যপণ্যের দামের অস্থিরতায় জীবন-সংসার চালাতে নাভিশ্বাস উঠছে তার। সরকারিভাবে ঘর পেতে স্থানীয় মেম্বার-চেয়ারম্যাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে ক্লান্ত। শুধু বিধবা ভাতার টাকায় খাবার জুটছে না আর। তাই ভাতার টাকা শেষ হলে কখনো কখনো তাকে বের হতে হচ্ছে ভিক্ষা করতে।
সুখজাদীর মতো অনেক প্রতিবন্ধী, বিধবা ও বয়স্ক ভাতাভোগীদের এমনই অবস্থা। উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে সুবিধা ভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভোটে কাজ করা কর্মীসহ নিকটতম আত্মীয়-স্বজনদের প্রথমেই ভাতার ব্যবস্থা করেন জনপ্রতিনিধিরা। অধিকাংশ সুবিধাভোগীই স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে তাদের খুশি করেই ভাতার সুযোগ পেয়ে থাকেন। বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধী ভাতা ভোগী অনেকেই তাদের এরকম অভিজ্ঞতার কথা অকপটে স্বীকার করেন। সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে স্বচ্ছভাবে ভাতার টাকা পেলেও নিত্যপ্রয়েজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর পাশাপাশি ভাতাভোগী পরিবারসহ নিম্ন আয়ের মানুষ দুর্বিসহ জীবনযাপন করছেন।
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা রায়হানুল ইসলাম জানান, উপজেলার ৬ ইউনিয়নে বয়স্ক ভাতাভোগী ১১ হাজার ৪৭৩ জন, বিধবা ভাতাভোগী ৪ হাজার ৯৫১ জন, প্রতিবন্ধী ভাতাভোগী ৩ হাজার ৪৪৬ জন। এ ছাড়াও বিশেষ ভাতাভোগী (দলিত সম্প্রদায়) ৩১ জন, শিক্ষা উপবৃত্তি পান ২০ জন এবং প্রতিবন্ধী উপবৃত্তি পান ১৯৭ জন। সব মিলিয়ে মোট ২০ হাজার ১১৮ জন সুবিধাভোগী সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধা পাচ্ছেন। আগে ভাতাভুক্ত হওয়া ও ভাতার টাকা উত্তোলন করতে টুকিটাকি সমস্যা থাকলেও এখন অনলাইন সুবিধা আসায় ভাতা প্রদানে স্বচ্ছতা ফিরেছে।
তিনি আরও জানান, বয়স্ক, প্রতিবন্ধী ও বিধবা ভাতা পাওয়ার উপযোগী প্রায় সাড়ে ৪ হাজার মানুষকে এখনো তালিকাভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। তবে পর্যাপ্ত বরাদ্দ আছে। বরাদ্দ আসামাত্রই তারা ভাতা সুবিধা পাবেন। ভাতার টাকার পরিমাণ কম হলেও তারা কিন্তু সরকারিভাবে সহায়তা পাচ্ছেন। ভাতা বাড়ানোর বিষয়ে তিনি বলেন, এটা একান্তই সরকার ও সমাজ সেবা মন্ত্রণালয়ের।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুমন দাস জানান, আগে ভাতাভোগীদের কিছুটা দুর্ভোগ থাকলেও বর্তমান অনলাইন সুবিধা আসার পর থেকে ভাতাভোগীরা স্বচ্ছতার সঙ্গে ভাতার টাকা উত্তোলন করতে পারছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ালেও এসব ভাতাভোগীসহ স্বল্প আয়ের মানুষজন যেকোনো উপায়ে পরিবার-পরিজনদের জীবন নির্বাহ করছেন। স্বল্প আয়ের মানুষকে সহায়তা দেওয়ার সময় প্রতিটি দপ্তর সমন্বয় করে দেওয়া হলে নিম্নআয়ের মানুষ সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে না। সরকার কিন্তু ভাতাভোগীসহ নিম্ন আয়ের মানুষকে সহায়তা দেওয়ার বিষয়টি অব্যাহত রেখেছেন। তবে বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধী ভাতাভোগীর ভাতা বৃদ্ধির বিষয়ে তিনি বলেন, বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষেকে জানানো হবে।
এসএন