রমেকে থেমে নেই 'বকসিস' সিন্ডিকেট চক্রের অবাধ বিচরণ
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৬ কর্মচারীর বদলি করেও থেমে নেই বকসিস ‘সিন্ডিকেট চক্রের অবাধ বিচরণ। হাসপাতালে রোগী ও স্বজনদের জিম্মি করে 'বকশিসের' নামে ছয়-সাত গুন বেশি রোগী ভর্তি ফি আদায় এবং ট্রলিতে রোগীদের বহন করতো চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের 'সিন্ডিকেট চক্র'। এখানে লাশ নামাতেও জোর করে টাকা আদায়সহ নানান অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।
গত মঙ্গলবার রাতে এমন অভিযোগে হাসপাতালটির ১৬ কর্মচারীকে স্ট্যান্ড রিলিজ করে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে বদলির আদেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এই আদেশ স্থগিতের জন্য সিন্ডিকেট চক্রটি বিভিন্নভাবে তদবির অব্যাহত রেখেছে। সেই সঙ্গে হাসপাতালের জরুরি বিভাগসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডে বৃহস্পতিবারও ট্রলি বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অপকর্ম অব্যাহত ছিল বলে অভিযোগ উঠেছে।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর একই হাসপাতালের চিকিৎসক রাশেদুল আমিনের মাকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে নিলে ভর্তি ফি ২০০ ও ট্রলি ফি ২০০ টাকা দাবি করেন কর্মচারী নেতারা। এ ঘটনায় ১৯ সেপ্টেম্বর রংপুর মেডিকেলের চিকিৎসক হাসপাতালের পরিচালকের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। পরে চুক্তিভিত্তিক তিন কর্মচারীকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। চিকিৎসকের মায়ের কাছে টাকা চাওয়ার বিষয়টি নিয়ে অন্যান্য চিকিৎসকের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
এ ঘটনার প্রতিবাদে ২৬ সেপ্টেম্বর হাসপাতালের সামনে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেন চিকিৎসকরা। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ও তাদের সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়ার ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেন। ওই সময়ের মধ্যে ১৬ কর্মচারীকে বদলির আদেশ দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে আরও ৭৫ জনকে বদলির প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা গেছে।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৬ কর্মচারীকে বদলির আদেশ দেওয়ার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হাসপাতাল চত্বরে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। বদলির আদেশ পাওয়া কর্মচারী ও তাদের গডফাদাররা গা ঢাকা দিয়েছে। সিন্ডিকেটের মূল হোতারা কর্মচারী ইউনিয়নের নেতা। তাদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা মামলাও রয়েছে। এদের কয়েকজন অনেক আগে থেকে সাসপেনশনেও রয়েছে। সাধারণ কর্মচারীদের অভিযোগ, হাসপাতালে নৈরাজ্য সৃষ্টি কারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়া হলে হাসপাতালের অবস্থা স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা।
বৃহস্পতিবার বিকালে হাসপাতালের জরুরি বিভাগ সহ বিভিন্ন ওয়ার্ডে ঘুরে দেখা গেছে, ১৬ কর্মচারী এক যোগে বদলির আদেশ হওয়ার পরেও দালালের দৌরাত্ম কমেনি। বিশেষ করে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের কথিত নেতার ক্যাডাররা হাসপাতালের জরুরি বিভাগে রোগী ভর্তি বাবদ ২৫ টাকার স্থলে থেকে দেড়শ টাকা পর্যন্ত আদায় করেছে। তবে কিছুটা রাখ-ঢাক করে টাকা নেওয়া হয়েছে। ট্রলি বাণিজ্য অব্যাহত ছিল।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জরুরি বিভাগে নীলফামারী থেকে আসা অসুস্থ মমতাজ মিয়াকে অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামানোর পর পরেই ট্রলি বহনকারী কর্মচারী দুই জন ব্যক্তি তাকে ট্রলিতে তুলে দেড়শ টাকা দাবি করেন। রোগীর স্বজনরা টাকা দিরেত রাজি না হওয়ায় তারা আধাঘণ্টা ধরে রোগীকে ট্রলিতেই শুইয়ে রাখে। পরে পুলিশের একটি দল ঘটনা স্থলে গেলে ট্রলি ওয়ালারা সটকে পড়ে। পরে স্বজনরাই তাকে বহন করে মেডিসিন ওয়ার্ডে নিয়ে যায়।
দেখা যায় হাসপাতালে ১০ দিন চিকিৎসা নিয়ে একটু সুস্থ হয়ে ট্রলিতে করে চার তলা থেকে নীচে নামানো বৃদ্ধা আকলিমা বেওয়ার স্বজনদের সঙ্গে। তাদের কাছে দুই নারী ট্রলি বহনকারী ৩০০ টাকা দাবি করে। কিন্তু রোগীর স্বজনরা ১০০ টাকার বেশি দেবেন না জানালে এ নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ তর্কবিতর্ক চলার পর শেষ পর্যন্ত দেড়শ টাকা নেয়। এ ব্যাপারে ট্রলি বহনকারী আসমা বেগমের কাছে টাকা দাবি করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রোগীর লোকজন এমনিতেই বকশিস দেয়, বলতে হয় না।
হাসপাতালের ১০ নম্বর শিশু ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেছে, কুড়িগ্রাম থেকে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ভর্তি থাকা ১০ বছরের শিশু ময়নাকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন তার মা। তিনি বলেন, ডাক্তার তার মেয়ের জন্য কয়েক ধরনের রক্ত পরীক্ষা করতে বলেছে। হাসপাতালে প্যাথলজি বিভাগে গিয়ে তিনি দেখতে পান সেটি বন্ধ। তাকে বাইরে প্যাথলজি ল্যাবরেটরি থেকে পরীক্ষা করে রিপোর্ট আনতে বলা হয়। এ সময় হাসপাতালের আশ-পাশে থাকা বিভিন্ন প্যাথলজির লোকজন ঘোরাঘুরি করছে। এর মধ্যে সেবা প্যাথলজির এক কর্মী রক্ত পরীক্ষা করে রিপোর্ট পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে রক্ত নিয়ে গেছে।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুজন নার্স জানায়, হাসপাতালে দীর্ঘদিন ধরে প্যাথলজিকাল পরীক্ষা বন্ধ। এখানে হাসপাতালের বাইরে থাকা পপুলার, আপডেট, ল্যাবএইড সহ বড় বড় ডায়গনস্টিক সেন্টারের কর্মীরা বিভিন্ন ওয়ার্ডে এসে রক্তের নমুনা সহ অন্যান্য পরীক্ষার জন্য নিয়ে যায়। এ ছাড়াও পুরো হাসপাতালে কে দালাল আর কে কর্মচারী বোঝা মুসকিল।
দালালরা রোগীদের বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে ক্লিনিকে রোগী নিয়ে যাচ্ছে। প্রতিবাদ করলে সিন্ডিকেট চক্রের হাতে নাজেহাল হতে বলে জানান। মেডিসিন, গাইনি, অর্থপেডিক্স, সাজারিসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডে ঘুরে রোগী ও তাদের স্বজনদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সিরিন্স থেকে শুরু করে সকল চিকিৎসা সামগ্রী বাইরে থেকে কিনে আনতে হয়। ডাক্তার প্রেসক্রিপশন করে দিলেও সিন্ডিকেট চক্র সেই বরাদ্দ করা ওষুধ না দিয়ে বাইরে থেকে আনতে বলে। ফলে এখানে চিকিৎসার নামে চলছে অত্যাচার।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ শরীফুল হাসান জানান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ১৬ জনকে এক যোগে বদলির আদেশ দিয়েছেন। তাদের ৭ দিন সময় দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট স্থানে যোগদান করার জন্য।বদলির আদেশ বাতিল হওয়ার কোনও সুযোগ নেই। তিনি গণমাধ্যম কর্মীদের সহযোগিতা কামনা করে বলেন, এক মাস হলো পরিচালক হিসেবে যোগদান করেছি। এখানে সকল ক্ষেত্রেই অনিয়ম ও দুর্নীতি। চেইন অব কমাণ্ড নেই। সময় দেন সব পরিষ্কার করে ফেলবো।
এএজেড