‘মাঘের বৃষ্টি হামার আলু শ্যাষ করচে বাহে’
রংপুরে দুই দিনের বৃষ্টিতে আলুসহ বিভিন্ন ফসলি জমিতে বৃষ্টির পানি জমেছে। এতে আলুর ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। কিছু দিন পরেই জমি থেকে আলু তোলার ধুম পড়ত এ জেলায়। কিন্তু মাঘের শেষে বৃষ্টিতে এখন বেশিরভাগ আলুর জমি পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
মাঘের শেষে শীতের বিদায় ক্ষণে আবহাওয়ার এমন ছন্দপতনে শঙ্কিত রংপুরের আলু চাষিরা। বৃষ্টি বেশি হলে জমিতে পানি জমে আলু নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় এখন আলু তোলার ধুম পড়েছে। নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর সবাই মিলে মাঠ থেকে আলু তুলছে।
রংপুর আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজুর রহমান জানিয়েছেন, গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ৫৬ দশমিক ৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
রংপুরের কৃষকরা বলছেন, এ অবস্থা আরও ২-৩ দিন স্থায়ী হলে আলু ছাড়াও সরিষা, গম, সবজিসহ অন্য ফসলও নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
জেলার মিঠাপুকুরের শঠিবাড়ী সেড়ুডাঙ্গা এলাকার আবু বকর সিদ্দিক নামে আরেক কৃষক বলেন, ‘মাঘের বৃষ্টি হামাক শ্যাষ করচে বাহে। জমির রোপন করা সোগ ধান বৃষ্টির পানির তলে গেইছে। আলু আর সরিষার খ্যাতেরও একই অবস্থা। আলুর জমিতে পানি জমি থাকলে তো পঁচন ধরবে। এমনিতে এবার আলুর দাম নাই, তার ওপর বৃষ্টিতে হামরা শ্যাষ। এমন হইলে কেমন করি আলুর আবাদ করমো।’
রংপুর সদর উপজেলার সদ্যপুষ্কুরণী ও মমিনপুরের বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে এমনটি জানা গেছে। এ পরিস্থিতি শুধু রংপুর সদরই নয় জেলার মিঠাপুকুর, পীরগাছা, কাউনিয়া, পীরগঞ্জ, বদরগঞ্জ, তারাগঞ্জ, গঙ্গাচড়া উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকাজুড়ে। বৃষ্টি বিড়ম্বনায় আলু নিয়ে চিন্তায় আছেন রংপুরের আলু চাষিরা।
গত বৃহস্পতিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) রাত থেকে শনিবার (৫ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যা পর্যন্ত থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়ায় জেলার বেশির ভাগ আলুর জমিতে পানি জমেছে। কৃষকরা কিছু জমি থেকে আগাম জাতের আলু তুললেও বেশির ভাগ এখনও উঠানো হয়নি। জমিতে পানি জমে থাকায় তারা হতাশায় ভুগছেন। এখন কোথাও কোথাও জমি থেকে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন করা হচ্ছে, আবার কোথাও কোথাও আলু তোলা হচ্ছে।
রংপুরের পীরগাছা উপজেলার অন্নদানগর গ্রামের কৃষক নুর হোসেন জানান, শুক্রবারের (৪ ফেব্রুয়ারি) বৃষ্টির পর শনিবার সকাল থেকেই জমি থেকে পানি নিষ্কাশনের নানা উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি প্রায় ৫৬ শতাংশ জমিতে আলু চাষ করেছেন। দুই দিনের বৃষ্টিতে আলুগাছ পানিতে তলিয়ে গেছে। জমে থাকা পানি সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। পুনরায় বৃষ্টি হলে ব্যাপক ক্ষতি হবে। যদি রবিবার অথবা সোমবার থেকে টানা রোদ উঠে তাহলে আলু কিছুটা রক্ষা পেতে পারে।
রংপুর নগরীর সাহেবগঞ্জ এলাকার আলু চাষি শামছুল হক ১০ একর জমিতে এবার আলুর আবাদ করেছেন।
বৃহস্পতিবার রাতে বৃষ্টি শুরু হলে শুক্রবার সকাল থেকে আলু খেতের নালা দিয়ে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু দুপুর থেকে আবার বৃষ্টি শুরু হওয়াতে তিনি এখন ক্ষতির আশঙ্কা করছেন।
তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে আমার বেশ কিছু জমির আলু তোলা শুরু হয়েছে। আবহাওয়া ভালো না হলে দুই-এক দিনের মধ্যে সব আলু তুলতে হবে।
রংপুর সদর উপজেলার সদ্যপুষ্কুরণী ইউনিয়নের পালিচড়া গ্রামের আলু চাষি মিজানুর বলেন, ‘আমার ৫ বিঘা জমির আলুগাছ পানিতে তলিয়ে গেছে। এবার ধার-দেনা করে আলুর আবাদ করেছি। এখন যে অবস্থা তাতে অর্ধেক টাকার আলু বিক্রি করতে পারব কিনা সন্দেহ। শীতের মাঝে মাঘ মাসে হঠাৎ এমন বৈরি আবহাওয়ার কারণে বৃষ্টির পানি জমে থাকা খেত থেকে কোমর বেঁধে আলু তুলতে নেমে পড়েছেন কৃষকরা।
এবার আলুর বাম্পার ফলন হলেও বাজার দর আর হঠাৎ বৃষ্টির প্রভাবে কৃষকের মুখে হাসি নেই। মৌসুমের শুরুতে আগাম জাতের আলু প্রতি বস্তা (৯০ কেজি) দেড় হাজার থেকে দুই হাজার টাকা দরে বিক্রি করা হলেও গত দুই সপ্তাহ থেকে বাজারে ধস নেমেছে।
বর্তমান বাজারে প্রতি বস্তা ইস্ট্রিক, ডায়মন্ড, কার্ডনাল জাতের আলু ৫০০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা এবং গ্রানুলা জাতের আলু ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে। যা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে পাইকারি কেজি দরে ৫ থেকে ৭ টাকা করে। কিন্তু এসব আলুতে উৎপাদন খরচ হয়েছে কেজি প্রতি ১০ থেকে ১১ টাকা করে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ওবাইদুর রহমান মণ্ডল বলছেন, ভারি বৃষ্টি হলে বা দুই-এক দিন আবহাওয়ার পরিবর্তন না হলে মাঠে থাকা আলুর ক্ষতির শঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে নিচু জমির আলু চাষিরা বিপাকে পড়বেন। আলু যেহেতু পচনশীল, তাই যত দ্রুত সম্ভব জমি থেকে পানি নিষ্কাশন করতে হবে। না হলে ক্ষতির মুখে পড়বেন কৃষকরা।
অকাল বৃষ্টিতে কী পরিমাণ আলুর ক্ষতি হয়েছে, তার হিসাব নেই কৃষি বিভাগে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ অঞ্চলে ৯৭ হাজার ৩১৫ হেক্টর জমিতে আলু উৎপাদন করা হয়েছে। এ বছরও একই পরিমাণ জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এর মধ্যে রংপুর জেলায় ৫১ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমিতে আলু চাষ করা হয়েছে। যার মধ্যে প্রায় ৬ হাজার হেক্টর আগাম জাতের আলু রয়েছে।
রংপুর আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজুর রহমান জানিয়েছেন, রংপুর জেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় ৫৬ দশমিক ৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
শনিবারের পর রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলে বৃষ্টির প্রভাব কমে আসবে। বৃষ্টির ফলে দিনের তাপমাত্রা আরও একটু কমে আসবে।
/এমএসপি