'বুক কাঁপছে, তলিয়ে যাচ্ছে সোনার ধান’
ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের চাপে সুনামগঞ্জে তাহিরপুর উপজেলার নজরখালী বাঁধ ভেঙে শনিবার সকাল থেকে পানি ঢুকছে টাঙ্গুয়ার হাওরে। তলিয়ে যাচ্ছে জমির ধান।
সোমবার (৪ এপ্রিল) বিকালে শাল্লা উপজেলার বাঘার হাওরে বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে পড়ে। কৃষকদের চোখের সামনেই ভেসে যাচ্ছে হাজার একর ফসলি জমি। এ ছাড়া মঙ্গলবার (৫ এপ্রিল) সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে ঢলের পানিতে শাল্লা ও ধর্মপাশা উপজেলার পাঁচটি বাঁধ উপচে হাওরে পানি ঢুকে। পানি ঢোকার কিছু সময় পরেই বাঁধগুলো ধীরে ধীরে ভাঙতে থাকে। এতে শতাধিক হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে।
এ ছাড়া ফাটল দেখা দিয়েছে জেলার আরও বেশ কয়েকটি ফসল রক্ষা বাঁধে। এরই মধ্যে সীমান্তের ওপার ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের সুনামগঞ্জের সব নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় ঝুঁকিতে আছে হাওরের বহু বাঁধ। এদিকে হাওর এলাকায় চাষ করা ধান এখনো সবুজ, কাঁচা। পাকতে সময় লাগবে আরও ১২থেকে ১৫ দিন। এর মধ্যেই ভারী বৃষ্টি ও উজানের পাহাড়ি ঢলে কৃষকের শ্রমে–ঘামে ফলানো ‘সোনার ধান’ ঝুঁকির মুখে পড়েছে। এতে চরম আতঙ্ক আর উদ্বেগে আছেন হাওরপাড়ের কৃষকেরা।
কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সুনামগঞ্জের ছোট-বড় ১৫৪টি হাওরে এবার ২ লাখ ২২ হাজার ৮০৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, ৩ হাজার ২২০ কোটি টাকার বোরো ধান। চলতি মৌসুমে জেলার ১২টি উপজেলার বিভিন্ন হাওরে বোরো ফসলের সুরক্ষার জন্য ৭২৪টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) মাধ্যমে ১৩০টি ঝুঁকিপূর্ণ ক্লোজারসহ ৫৩২ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। এ জন্য সরকার ১১৯ কোটি ৮৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে।
যদিও আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, এখনই বন্যার কোনো আশঙ্কা নেই। তবে সুনামগঞ্জ জেলায় প্রবল বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের কারণে দেখা দেয় অকাল বন্যা। মার্চের দিকে শুরু হওয়া এ বন্যায় হাওরের বোরো ধান ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ফলে ধান রক্ষায় প্রতি বছর হাওরে নির্মাণ করা হয় ফসলরক্ষা বাঁধ। এ বছরে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সুনামগঞ্জ জেলার হাওরের বাঁধ নির্মাণ কাজ শতভাগ শেষ করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও নির্দিষ্ট সময়ে বেশিরভাগ বাঁধের নির্মাণ কাজ শেষ করতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা। নির্ধারিত সময়ে বাঁধের কাজ শুরু ও শেষ না হওয়ায় আজ হাওরের এমন দশা। একই সঙ্গে হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে স্বেচ্ছাচারিতার অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুনামগঞ্জে প্রতি ৪-৫ বছর পর পর হাওরে চরম বিপর্যয় নেমে আসে। অকাল বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে হাওরের ফসলের ক্ষতি হয়। ২০১৭ সালে সুনামগঞ্জ জেলার হাওর বিপর্যয়ের পর শঙ্কামুক্ত ৪ বছর কাটিয়েছেন কৃষকেরা। এবার ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণের দায়িত্ব পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো)।
বোর্ড আগে ঠিকাদারদের মাধ্যমে বাঁধের নির্মাণ করত। তবে ২০১৭ সালের ফসলহানির পর সমালোচনার মুখে এ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা হয়। ২০১৮ সাল থেকে স্থানীয় উপকারভোগীদের সমন্বয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠন করে বাঁধের কাজ করা হচ্ছে। প্রতিটি বাঁধের জন্য স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) আহ্বায়ক ও উপজেলা পাউবো কর্মকর্তাকে সদস্য সচিব করে গঠন করা হয় আলাদা আলাদা পিআইসি। তবে নির্মাণকাজে পরিবর্তন আনা হলেও বন্ধ হয়নি হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে স্বেচ্ছাচারিতার অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ। এ কারণে বাঁধের উপর আস্থা ছিল না কৃষকদের। তাদের আস্থা না থাকার যৌক্তিক কারণের প্রমাণও মিলেছে, জেলার বেশ কয়েকটি হাওরের বাঁধে ভাঙন ও বাঁধে ফাটল দেখা দেয়। বর্তমান সময়ে হাওরে হাওরে ফসল রক্ষার যুদ্ধ করছেন সুনামগঞ্জের কৃষকরা। বেশিরভাগ কৃষক ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
অসময়ে হওয়া বাঁধের মাটি কমপেকসন না হওয়ায় (না বসায়) বৃষ্টি পড়তেই ফাটল দেখা দিয়েছে, কোথাও কোথাও বাঁধের নিচ দিয়ে হাওরে পানি ঢুকছে, পিআইসিসহ বাঁধ নির্মাণকারীদের অবহেলায় এখন কৃষকের যত ক্ষয়ক্ষতি আর ভোগান্তি।
ক্ষোভ প্রকাশ করে মাটিয়ান হাওরপাড়ের কৃষক কবির আহমেদ বলেন, ‘বাঁধে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। বাঁধে নামমাত্র মাটি ফেলে দুরমুজ না করে দায়সারা ভাবে কাজ করেছে দায়িত্ব প্রাপ্ত পিআইসি। বিভিন্ন বাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে বৃষ্টিও থামছে না। ফসল নিয়ে আমরা খুবই শঙ্কায় আছি। বুক কাঁপছে, রাত জেগে বাঁধ পাহারা দিচ্ছি, ফসল তলিয়ে গেলে আমাদের না খেয়ে মরতে হবে।’
স্থানীয় আরেক কৃষক জিয়াদ আলী ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘৪৪ নম্বর প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা পিআইসি সভাপতি ফিজিল মিয়া ও সেক্রেটারি কয়েছ মিয়া বাঁধ নির্মাণ কাজ নিয়ে গাফেলতি করেছেন। বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম হওয়ার কারণেই আমরা এখন ফসল নিয়ে ঝুঁকিতে রয়েছি। রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে।’
বোয়ালা হাওরের কৃষক আব্দুল মালেক ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, হাওরে কোটি কোটি টাকার বাঁধ নির্মাণ হচ্ছে। তবে কয়েকটি বাঁধের জন্য প্রতি বছরই কেন আমরা সোনার ফসল নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকব? বাঁধে প্রয়োজনীয় বাঁশ ও বস্তা লাগানো হয়নি। নদীতে পানি বাড়ায় ভাঙছে বাঁধ। বাঁধে সার্বক্ষণিক পাহারা দিতে হচ্ছে। জরুরি ভিত্তিতে বাঁধে এখন বাঁশ ও বস্তা দিয়ে শক্ত করতে আমরা গ্রামের মানুষ রোজার দিনে রোজা অবস্থায় কাজ করতে হচ্ছে। একটি সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করলেই আমরা শঙ্কামুক্ত থাকি।
সর্বশেষ ২০১৭ সালে ফসলডুবিতে হাওর থেকে একেবারে শূন্য হাতে ফিরেছিলেন সুনামগঞ্জের কৃষকেরা। এবারও শুরু থেকেই একটা আশঙ্কা ছিল। হাওরে কৃষক থেকে শুরু করে সুনামগঞ্জ জেলার একাধিক স্থানীয় বাসিন্দা ঢাকাপ্রকাশকে জানান, উজান থেকে যেভাবে পাহাড়ি ঢল নামছে, এর মধ্যে বৃষ্টিও থামছে না। নদ-নদীর পানি বাড়ছে, এতে করে তারা ২০১৭ সালের মতো পরিস্থিতির আশঙ্কা করছেন। বৃষ্টি ও ঢল না থামলে পানি উন্নয়ন বোর্ড যেসব বাঁধ দিয়েছে, তাতে ফসল রক্ষা হবে না।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার করচার হাওরপাড়ের কৃষক বরকত উল্লাহ ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘হাওরে সবুজ ধান ক্ষেতে ধানে মাত্র শিষ আসছে। নদীতে পানি ভরে গেছে। এর জন্য মনে ভয় ঢুকছে। এ জমির ধানের উপরই আমরার বাঁচা-মরা। একমাত্র বোরো ফসল দিয়ে আমার সাত সদস্যের পরিবারের জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম। ৩০ কেদার (৩০ শতাংশে ১ কেদার) জমিতে ধারদেনা করে এবার বোরো আবাদ করেছি। ধান তুলতে পারলে ধারদেনা শোধ করে সারা বছর নিশ্চিন্তে চলতে পারব। ফসল তুলতে না পারলে পথে বসা ছাড়া উপায় নেই।’
হাওর বাঁচাও আন্দোলনের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সালেহীন শুভ ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, শুধু উজানের ঢলের দোহাই দিলে চলবে না, ফসল ঝুঁকিতে পড়ার মূল কারণ হচ্ছে বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম ও গাফিলতি। নির্ধারিত সময়ের এক মাস পরও বাঁধের কাজ শেষ হয়নি। মূল কাজ রেখে প্রশাসন, পাউবোর কর্মকর্তারা কীভাবে একের পর একে প্রকল্প আর প্রাক্কলন বাড়ানো যায়, সেটিতেই গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি। হাওরের ফসল নিয়ে আমি শঙ্কিত। শুধু বাঁধ দিয়ে যে ফসল রক্ষা হবে না, সেটি আমরা বহুদিন ধরে বলে আসছি। ফসল রক্ষা করতে হলে বাঁধের সঙ্গে নদী ও খাল খনন করতে হবে। কিন্তু তা হয়নি।
সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী জহুরুল ইসলাম জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জে বৃষ্টি হয়েছে মাত্র ৭ মিলিমিটার। কিন্তু ভারতের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি হয়েছে ৪৩৪ মিলিমিটার। এ বৃষ্টির পানি নিচের দিকে নামছে। সুনামগঞ্জে সুরমা নদীর ষোলঘর পয়েন্ট দিয়ে ৫ দশমিক ৯৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি যাচ্ছিল। সুরমা নদীর এ পয়েন্টে হাওরের বাঁধের বিপৎসীমা ৬ দশমিক ০৫ সেন্টিমিটার। বিপৎসীমার কাছাকাছি অবস্থায় থাকা এ পানি আরও বাড়লে পরিস্থিতি সামাল দেওেয়া কঠিন হবে বলে আগামী ২৪ ঘণ্টা সময়কে সুনামগঞ্জের জন্য বিপজ্জনক সময় উল্লেখ করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান করুণা সিন্ধু বাবুল বলেন, নির্ধারিত সময়ে বাঁধের কাজ শুরু ও শেষ না হওয়ায় আজ হাওরের এমন দশা। অনিয়ম দুর্নীতির মানুষের ফসল ঝুঁকিতে রয়েছে। কৃষকদের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। পরিস্থিতি মোটেও ভালো নয়। যেভাবে নদীর পানি বাড়ছে এটি অব্যাহত থাকে তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। মানবিক বিপর্যয় দেখা দেবে।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, আমরা হাওরে ফসল রক্ষায় প্রাণপণ চেষ্টা করছি। কিন্তু যেভাবে উজানের ঢল নামছে, তা অস্বাভাবিক। প্রশাসনের সব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের হাওরে নজর রাখতে বলা হয়েছে। যে বাঁধগুলো ত্রুটিপূর্ণ এবং সংস্কারের প্রয়োজন সেগুলোর কাজ করা হচ্ছে। পিআইসি গঠনে ও বাঁধ নির্মাণ কাজে যদি কোনো অনিয়ম থাকে, তাহলে আমি তদন্ত কমিটি গঠন করব। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে যারা যারা এতে দোষী সাব্যস্ত হবেন এবং যারা কর্তব্য অবহেলায় অভিযুক্ত হবেন তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। সরকারি কর্মকর্তা হলে সরকারের কাছে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করব এবং পিআইসি হলে সরাসরি মামলা করা হবে।
এসএন