শ্যামপুর সুগারমিল বন্ধ
বাড়ছে দেনা, নষ্ট হচ্ছে যন্ত্রপাতি
চিনি উৎপাদনে ৫০৫ কোটি টাকা লোকসানের মুখে পড়ায় রংপুরের শ্যামপুর চিনিকল বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। এতে বেকার হয়ে পড়েন কয়েক হাজার শ্রমিক ও আখ চাষি। গত ২০২০-২১ অর্থ বছরে মাড়াই মৌসুমে মিলের কার্যক্রম বন্ধ করে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন।
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনসহ অন্য খাত মিলে বকেয়া রয়েছে প্রায় ২১ কোটি টাকা। নিয়মিত বেতন-ভাতা না পাওয়ায় পরিবার নিয়ে কষ্টে দিন পার করছেন চিনিকল কর্মচারী ও শ্রমিকরা। এ অনিশ্চয়তা কাটাতে বিকল্প উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির লক্ষ্যে কিছু প্রস্তাবনা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হলেও এখনও তা আলোর মুখ দেখেনি। এদিকে দীর্ঘ সময় উৎপাদন বন্ধ থাকায় চিনিকলের যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে। আখ পরিবহনে ব্যবহৃত ট্রাক্টরগুলোও বিকল হয়ে পড়ছে ।
সুগার মিল এলাকায় দেখা গেছে, এক সময়ের প্রাণচাঞ্চল্যে চিনিকল এলাকাটিতে এখন সুনসান নিরবতা। দাপ্তরিক কার্যক্রম চললেও নেই আগের সেই ব্যস্ততা। বেশিরভাগ দপ্তরে তালা ঝুলছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীর উপস্থিতিও কম। যারা আছেন তাদের মুখে নিস্তব্ধের ছাপ।
চিনিকলের কারখানা বিভাগের জুনিয়র ইলেকট্রিশিয়ান ও এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের সহসভাপতি আব্দুস সাত্তার বলেন, 'সরকার দেশের ১৫টি চিনিকলের মধ্যে ৬টি চিনিকলে মাড়াই বন্ধ রেখেছে। এভাবে আর কত দিন চলবে, এখনও বলা যাচ্ছে না। আমাদের বকেয়া বেতন-ভাতার কোনো সুরাহা হয়নি। সন্তানদের পড়ালেখা, সংসার চালানোসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচাপাতি করতে না পেরে আমাদের অবস্থা কাহিল হয়ে পড়েছে।'
শ্যামপুর চিনিকলে কর্মরত আমিনুল-সাত্তারের মতো শত শত শ্রমিক-কর্মচারী চোখে এখন অন্ধকার দেখছেন। চিনিকলের ওপর নির্ভর করে সংসার চালানো এখানকার শ্রমিক-কর্মচারীরা বলছেন, বেতনসহ অন্য খাত মিলে প্রায় ২২ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। দীর্ঘদিন হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত চিনিকলটিতে বিকল্প উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আট-নয় মাস ধরে বেতনও নেই। গত ১০ মৌসুমে চিনি উৎপাদনে মিলের লোকসান হয়েছে ৫০৫ কোটি টাকা। এখানকার সবাই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। নতুন বিনিয়োগে কৃষিনির্ভর শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়তে কিছু প্রস্তাবনা সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হলেও তা এখনও আলোর মুখ দেখেনি।
শ্যামপুর সুগারমিল কার্যালয় সূত্র জানা যায়, ১৯৬৪ সালে ১১১ দশমিক ৪৫ একর জমির ওপর নির্মিত হয় শ্যামপুর চিনিকল স্থাপন করা হয়। ১৯৬৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে আখমাড়াই শুরু হয়। দৈনিক আখমাড়াইয়ের সক্ষমতা রাখা হয় ১ হাজার ১৬ টন। বছরে তিন মাস মিল চালু থাকত। মিলটি শুরু থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত লাভজনক প্রতিষ্ঠান ছিল। ২০০০ সালের পর থেকে টানা লোকসানের মুখে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি। ব্যাংক ঋণ, ঋণের সুদ ও শ্রমিক-কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডসহ অন্যান্য খাত মিলে শেষ পর্যন্ত লোকসান বেড়ে হয় ৫০৫ কোটি টাকা। এ পরিস্থিতিতে শিল্প, বাণিজ্য, অর্থ ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি মিলটির মাড়াই কার্যক্রম বন্ধের সুপারিশ করে। এর প্রেক্ষিতে ২০২০-২১ মাড়াই মৌসুমে মিলের কার্যক্রম বন্ধ করে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন। মিল এলাকায় আখ উৎপাদন কমে যাওয়ায় এবং আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবে লোকসানের বোঝা বাড়ছে বলে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ দাবি করলেও তা মানতে নারাজ ছিলেন শ্রমিক-কর্মচারী ও আখ চাষিরা। তাদের দাবি, কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, অদক্ষ জনবল ও অব্যবস্থাপনাসহ নানা কারণে লোকসানে রয়েছে চিনিকলটি।
শ্যামপুর সুগার মিল শ্রমিক-কর্মচারী এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন ও আখচাষি কল্যাণ সমিতি আন্দোলনে মাঠে নামে। স্মারকলিপি দেওয়া হয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু ফল মেলেনি। শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায় মিলটি। সেই থেকে মিল এলাকায় বন্ধ আখ চাষ। আখ চাষের জমিগুলোতে কৃষকেরা এখন অন্যান্য ফসল চাষ করছেন।
চিনিকল এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের সদস্য ও চিনিকলের অফিস সহায়ক আমিনুল ইসলাম বলেন, শ্যামপুর সুগার মিলটি বন্ধ থাকায় গত বছরের জুন মাস থেকে বেতন বন্ধ। এর মধ্যে গত জানুয়ারি মাসের বেতন পেলেও বাকি আট মাসের বেতন এখনও পাইনি। এ অবস্থায় পরিবার-পরিজন নিয়ে কষ্টে আছি।
আব্দুস সাত্তার আরও বলেন, মিলটি বন্ধের আগে ৪৯৩ জন স্থায়ী ও অস্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিলেন। বন্ধের পর অনেকেই অবসর গ্রহণ করেছেন এবং কিছু জনবল অন্য মিলে বদলি হয়ে গেছেন। বর্তমানে এই চিনিকলে ১০৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিক বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত আছেন। তাদের দাবি, সরকারিভাবে ভর্তুকি দিয়ে হলেও মিলটি পুনরায় চালু করা হোক।
মিল কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, শ্রমিক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ড বাবদ ৭ কোটি, গ্রাচ্যুয়িটি বাবদ ১০ থেকে ১১ কোটি এবং বেতন বাবদ প্রায় ৪ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। এ অবস্থায় মিলটি উৎপাদনমুখী করতে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে গত বছরের নভেম্বরে কিছু প্রস্তাবনা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। এগুলো হলো মিলের নিজস্ব জায়গায় আলুর কোল্ড স্টোরেজ নির্মাণ, কৃষিভিত্তিক শিল্পকারখানা স্থাপন এবং পিপি ব্যাগ ও চিনির প্যাকেট তৈরির কারখানা স্থাপন সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠিয়েছেন মিলটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
সুগার মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কৃষিবিদ মো. আহসান হাবিব বলেছেন, বন্ধ থাকায় মিলটির যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে। আখ বহনের কাজে নিয়োজিত ট্রাক্টরগুলো পড়ে থাকায় নষ্ট হচ্ছে। কৃষিনির্ভর উত্তরাঞ্চলের অন্যতম একটি ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান ছিল শ্যামপুর সুগারমিল। এর সঙ্গে জড়িত কয়েক হাজার পরিবার। কিন্তু মিলটি বন্ধ হওয়ায় শ্রমিকসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কষ্টে দিন পার করছেন।
টিটি/