মোখা আতঙ্কে দক্ষিণ উপকূলের বেড়িবাঁধ এলাকার মানুষ
ঘূর্ণিঝড় মোখার গতি বাড়ছে। দেশের উপকূলের সঙ্গে ঘূর্ণিঝড় মোখার দূরত্ব কমছে। উপকূলের কাছাকাছি আসছে এটি। এতে আতঙ্কে রয়েছেন দক্ষিণ উপকূলের বেড়িবাঁধ এলাকার মানুষ।
শনিবার (১৩ মে) সকালে আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশীদ এ তথ্য জানিয়ে বলেন, শনিবার সন্ধ্যায় এই ঘূর্ণিঝড়ের অগ্রভাগের প্রভাব পড়তে শুরু করবে দেশের কক্সবাজার ও এর কাছাকাছি উপকূলীয় এলাকায়।
খুলনা আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ মো. আমিরুল আজাদ বলেন, এখন পর্যন্ত খুলনায় ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাব শুরু হয়নি। আজ রাত অথবা আগামীকাল রবিবার সকাল থেকে শুরু হতে পারে। খুলনায় ৪ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
তবে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা শঙ্কিত করে তুলেছে দেশের দক্ষিণ উপকূলের বাসিন্দাদেরও। বিশেষ করে খুলনার কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছা, সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি এবং বাগেরহাটের শরণখোলা, মোড়েলগঞ্জ ও মোংলা উপজেলার অনেক বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকায় এখানকার বাসিন্দাদের শঙ্কা বেড়েছে।
গত কয়েক বছরের একাধিক প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না পারা বাসিন্দারা ঝুঁকিপূর্ণ উপকূলরক্ষা বাঁধগুলো নিয়ে আবারও লোকালয় প্লাবনের শঙ্কায় রয়েছেন। এ অঞ্চলে এর আগে ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার সময় ৬৮৩ কিলোমিটার এবং ২০২০ সালে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের সময় ৪৭৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। যার ক্ষত এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি উপকূলবাসী। এর মধ্যেই মোখা আবারও শঙ্কিত করে তুলেছে দক্ষিণ উপকূলের বাসিন্দাদের।
কারণ খোদ পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়া তথ্য বলছে, ওই তিন জেলার প্রায় ৬০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত বা বড় ধরনের জলোচ্ছ্বাস হলে বাঁধ উপচে খুলনা উপকূলে পানি ঢোকার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
খুলনার কয়রা উপজেলার কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ৬ নম্বর ও ৪ নম্বর রিং বাঁধ, গাজীপাড়া, গোলখালী, হাজতখালী, জোড়শিং, মহেশপুর, ঘাটাখালী, হরিণখোলা ও মদিনাবাদ লঞ্চঘাট সংলগ্ন এলাকা এবং মঠবাড়িয়া ও হোগলা এলাকাসহ প্রায় ১২ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে পানির উচ্চতা বাড়লে এসব বাঁধ উপচে লোকালয় প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা আছে।
কয়রার উত্তর বেদকাশী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সরদার নুরুল ইসলাম বলেন, সাকবাড়িয়া নদীর পানির চাপ বেশি হলে আমাদের বাঁধ কোনোভাবেই টিকবে না। আম্পানের পর আমাদের গ্রামসহ আশপাশের এলাকার কয়েকশ' পরিবারের সবকিছু প্রায় ২ বছর ধরে পানির নিচে ডুবে ছিল। সাকবাড়িয়া এবং কপোতাক্ষ নদ যখন ভয়ংকর হয়ে উঠে তখন এই দুর্বল বেড়িবাঁধ কোনো কাজে আসে না। যতবারই ঝড় হয়েছে বাঁধের কোনো না কোনো জায়গা ভেঙে আমাদের গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত গাজীপাড়া ও গাতিরঘেরী এলাকায় গতবছর বাঁধ দেওয়া হয়েছিল। তবে তা এখনো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে।
দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) আবদুস সালাম খান বলেন, ঝড়ের চেয়ে আমাদের বড় ভয় বেড়িবাঁধ। উপকূল সুরক্ষায় অর্ধশত বছরেরও আগে নির্মিত বেড়িবাঁধ এখন আর সামুদ্রিক ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ধাক্কা সামাল দিতে পারছে না। বারবার ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলো জিও ব্যাগের বালুর বস্তা আর রিং বাঁধ দিয়ে কোনোরকম টিকিয়ে রাখা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, দুর্যোগ থেকে বাঁচতে এলাকার মানুষ বারবারই কংক্রিটের নদী বাঁধের দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু তা আর হয়নি।
মহেশ্বরীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহনেওয়াজ শিকারি বলেন, জোয়ার বাড়লে বাঁধের ধসে যাওয়া জায়গাগুলো দিয়ে পানি ঢুকবে। তাতে গোটা ইউনিয়ন তলিয়ে যেতে পারে।
বেড়িবাঁধ পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছে খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ড-২। ওই কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম বলেন, আমাদের আওতাধীন ৬৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের ১০ কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ। আর অতিঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ আছে ৩ কিলোমিটার।
তিনি আরও বলেন, এর মধ্যে কয়রা উপজেলায় আমাদের বেশি নজর রাখতে হচ্ছে। ওই এলাকাটি সুন্দরবন সংলগ্ন ও এর ৩ দিকে কপোতাক্ষ এবং শাকবাড়িয়া নদী। বড় আকারের জলোচ্ছ্বাস হলে ভালো বাঁধও ধসে যেতে পারে। তবে জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
এদিকে গত সপ্তাহে দাকোপ উপজেলার মোজামনগর, ঝালবুনিয়া, দক্ষিণ কামিনিবাসিয়া, জালিয়াখালী, মধ্যপানখালী, কালাবগী, সুতারখালী, চুনকুড়ি, ঢাংমারি, জাবেরের খেয়াঘাট, খোনা, গড়খালী, উত্তর কামিনিবাসিয়া, বটবুনিয়া, শিবসার পাড়, ভিটেভাঙ্গা, শ্রীনগর, কালীবাড়ি, গুনারী, খলিশা এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এসব জায়গার বাঁধের বেশিরভাগ অংশই ঝুঁকিপূর্ণ।
কামারখোলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পঞ্চানন কুমার মন্ডল বলেন, কালাবগী, নলিয়ান ফরেস্ট স্টেশনের পাশের এলাকা ও গুনারীসহ বাঁধের ৬-৭টি জায়গা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ২২০ কোটি টাকা ব্যয়ে বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় এখানে যে বাঁধ নির্মিত হয়েছিল, তা এখনই ভেঙে যাচ্ছে শিবসার পানির প্রবল চাপে। আর পাউবো যে বাঁধ নির্মাণ করে, তা তো কাজ শেষ হওয়ার আগেই ভেঙে যায়।
ওই এলাকার বেড়িবাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছে খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১। এ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুর রহমান তাজকিয়া জানান, তার দায়িত্বের অধীনে ৩৭৯ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ৩ কিলোমিটার অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এবং ৬ কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
এদিকে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, বুড়িগোয়ালিনী, আটুলিয়া, কাশিমাড়ী এলাকার কয়েকটি বেড়িবাঁধ অতিঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধিরা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে বুড়িগোয়ালিনী এলাকা।
বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ভবতোষ মণ্ডল বলেন, বুড়িগোয়ালিনীর দুর্গাবাটি ও দাতিনাখালীর ৩ জায়গায় বাঁধের অবস্থা ভালো না। গত আম্পানে জায়গাগুলো ভেঙে গিয়েছিল। পরে মেরামত করা হলেও তা পুরোপুরি ঠিক হয়নি।
গাবুরা ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য আবদুর রহিম বলেন, হরিষখালী, পার্শেমারী টেকেরহাট, গাবুরা, চকবারা ও লেবুবুনিয়াসহ ৫টি জায়গায় বেড়িবাঁধ জরাজীর্ণ হয়ে আছে। এমনিতেই প্রতিনিয়ত সেখানে বাঁধ ভাঙছে।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সালাউদ্দিন বলেন, আমাদের আওতাধীন ৩৮০ কিলোমিটার বাঁধের ২০ কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ ও ৩ কিলোমিটার অতিঝুঁকিপূর্ণ। অতিঝুঁকিপূর্ণ ৩ কিলোমিটার বাঁধ সংস্কার করা হচ্ছে।
সাতক্ষীরা ডিভিশন-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহনেওয়াজ জানান, তার আওতাধীন এলাকায় ৩০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ৩ কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এই বাঁধ দ্রুত মেরামতের জন্য চেষ্টা চলছে।
বাগেরহাটের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাসুম বিল্লাহ জানান, জেলার ৩৩৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে শ্যামনগর ও মোড়েলগঞ্জ উপজেলায় ১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। অর্থ বরাদ্দ না থাকায় তা মেরামত করা সম্ভব হয়নি।
তিনি আরও বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ এলাকা আমরা পর্যবেক্ষণে রেখেছি। নদীতে পানির উচ্চতা খুব বেশি না বাড়লে অসুবিধা হবে না বলে ধারণা তার।
এসজি