টাকা ছাড়া আবেদন ফরম পৌঁছায় না ইউএনও’র টেবিলে
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বাঁশদহা ইউনিয়নের কৃষক নিলু। ছেলের জন্ম তারিখ ১৯৯৭ সাল আর মেয়ের ২০০১ সাল। তবে জন্ম নিবন্ধনে ছেলে-মেয়ে উভয়ের জন্মের সাল লেখা হয়েছে ১৯৯৭। ছেলের জন্মের সাল ঠিক থাকলেও মেয়ের জন্মের সাল ঠিক ছিল না। এ কারণে মেয়ের জন্মের সাল সংশোধনের জন্য তিনি বাঁশদহা ইউনিয়ন পরিষদের ডিজিটাল সেন্টার থেকে আবেদন করেন এবং আবেদনের ফরম জমা দিয়েছিলেন ইউএনও অফিসের নিচ তলায় জমা নেওয়ার দায়িত্বে থাকা পিয়নদের কাছে। তবে তার সেই আবেদন ফর্ম ১ মাসেও নিচ তলা থেকে দ্বিতীয় তলায় ইউএনও’র টেবিলে পৌঁছায়নি। ১ মাস পর ইউএনও অফিসে এসে খোঁজ নিয়েছিলেন নিলু। তবে তার সেই আবেদন ফর্ম আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। তখন তিনি আবারও আবেদন করে জমা দেন নিচ তলায় দায়িত্বে থাকা পিওনদের কাছে। আবারও ১৫ দিন পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন তার সেই আবেদন ফরমও হারিয়ে গেছে। এরপর তিনি অন্য একজনের পরামর্শে বাধ্য হয়ে আবারও আবেদন করেন। তবে এবার তিনি পিয়নদের কাছে আবেদন ফরমটি জমা দেননি। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর সরাসরি জমা দেন ইউএনও মহাদয়ের কাছে। সঙ্গে সঙ্গে তার কাজটি করে দেন ইউএনও।
কৃষক নিলু বলেন, ‘জন্ম নিবন্ধন সংশোধনের জন্য আবেদন ফরম নিচে পিয়নদের কাছে জমা দিলে সেটি আর ইউএনও স্যারের কাছে পৌঁছায়নি। সেখান থেকে উধাও হয়ে যায়। যারা পিয়নদের টাকা দিতে পারছে তাদের কাজ দিনে দিনে হয়ে যাচ্ছে। মেয়ের জন্ম নিবন্ধন ঠিক করতে আমার ৫ দিন যেতে হয়েছে উপজেলায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি গরিব, মূর্খ মানুষ। তেমন একটা কিছু বুঝি না। ইউনিয়ন পরিষদ হতে আমাকে উপজেলার নিচের তলায় জমা দিতে বলেছিল বলে জমা দিয়েছিলাম। ৫ দিন আমার কাজ কামায় হয়েছে। এ ছাড়া যাতায়াতেও আমার অনেক খরচ হয়েছে। আমার জীবনে এতো ভোগান্তিতে আর পড়িনি।’
সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ের কয়েকজন কর্মচারীর কারণে কৃষক নিলুর মতো প্রতিদিন এমন ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন শত শত মানুষ। জন্ম নিবন্ধন ঠিক করতে না পেরে দিনের পর দিন ইউএনও অফিসে আসছেন আর ফিরে যাচ্ছেন তারা। ফলে সরকারের মহতি উদ্যোগ প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সাতক্ষীরা সদর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের উদ্যোক্তা ও স্থানীয় কিছু দালালের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে একটি সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের অফিস সহকারী তাজদিকুর রহমান। আর তাজদিকুর রহমানকে সহায়তা করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের পিয়ন আনিস, নরেশ, গৌরাঙ্গ। দিন শেষে যে টাকা ইনকাম হয় তা ভাগ বাটোয়ারা হয় ৫ ভাগে। তাজদিকুর রহমান, আনিস, নরেশ, গৌরাঙ্গ ছাড়াও ওই টাকার একটা অংশ চলে যায় সদর উপজেলা নিবাহী অফিসারের কার্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা রফিকুল ইসলামের পকেটে।
জানা যায়, সদরের কয়েকটি ইউনিয়নের উদ্যোক্তা ও দালালরা আবেদন ফরম সংগ্রহ করেন এবং তাদের কাছ থেকে ২০০, ৫০০ থেকে শুরু করে বিভিন্ন অংকের টাকা নেন। এরপর ওই উদ্যোক্তা ও দালালরা ওই ফরমগুলো জমা দেন উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ের ওই ৪ কর্মচারীর কাছে। দ্রুত কাজ করে দেবে এই শর্তে ওই ৪ কর্মচারী উদ্যোক্তা ও দালালদের কাছ থেকে ফরম প্রতি ৪০ টাকা থেকে শুরু করে ১০০ টাকা করে নিয়ে থাকেন। যে আবেদন ফরমগুলোর টাকা পান তাজদিকুর রহমান, আনিস, নরেশ, গৌরাঙ্গ ঠিক সেই ফরমগুলো তারা ইউএনও মহাদয়ের কাছে জমা দেন। আর ওই আবেদন ফরমগুলোর কাজ সম্পন্ন করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। এদিকে যারা দালালের মাধ্যমে টাকা দিয়ে কাজ না করে সরাসরি এসে ওই কর্মচারীদের কাছে জমা দেন তাদের ফরম উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে পৌঁছায় না। নিচ তলা থেকেই হারিয়ে যায়। ফলে দিনের পর দিন উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে আসছেন আর ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকেই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাতক্ষীরা সদর উপজেলা কার্যালয় সংশ্লিষ্ট একজন বলেন, ‘আমার নিজের এলাকার একজন জন্ম নিবন্ধন সংশোধনের জন্য আবেদন ফরম আমার কাছে দিয়ে গেলে আমি সেটি একজন পিয়নের কাছে দিয়েছিলাম। তবে সেটি দেড় মাসেও ইউএনও স্যারের কাছে পৌঁছায়নি। পরে আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ইউএনও স্যারের কাছ থেকে আবেদন ফর্মটি ঠিক করে নিয়েছিলাম।’
আপনি তো অফিস সংশ্লিষ্ট তা আপনারদের মাস লাগল কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘হয়তো আমি টাকা দিতে পারিনি এ জন্য আমার দেওয়া ফরমটি তারা ইউএনও স্যারের কাছে দেয়নি।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সদরের এক ইউপি উদ্যোক্তা বলেন, ‘টাকা না দিলে ইউএনও অফিসের পিয়নরা কাজ করেন না। ফরম প্রতি তাদের ৪০ টাকা থেকে শুরু করে আরো বেশি টাকা দিতে হয়। সরাসরি পিয়নদের কাছে ফরম জমা দিয়ে আমার এলাকার অনেকেই ভোগান্তিতে আছেন। তারা দিনের পর দিন আমার এখানে এসে খোঁজ নেন। তবে আমারতো কিছুই করার থাকে না। আমি তাদের উপজেলায় খোঁজ নিতে বলি।’
এ প্রসঙ্গে জানতে সাতক্ষীরা সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসের প্রশাসনিক কর্মকর্তা রফিকুল ইসলামের ব্যবহৃত মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তার ব্যবহৃত নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া যায়।
অভিযোগ অস্বীকার করেন অফিস সহকারী তাজদিকুর রহমানও। তিনি বলেন, ‘এখানে কোনও টাকা নেওয়া হয় না। ফরম জমা দিলে সিরিয়াল অনুযায়ী কাজ সম্পন্ন করা হয়।’
কিছু কিছু আবেদন ফরম মাসের পর মাস পড়ে থাকে কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সার্ভারের সমস্যা থাকে এ জন্য পড়ে থাকে।’ এরপর অফিসে আসতে বলে তিনি মোবাইলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফাতেমা-তুজ-জোহরা বলেন, ‘এমন অভিযোগ আমার কাছেও এসেছে। এ জন্য আমি প্রতিদিনের আবেদন ফরম প্রতিদিন আমার টেবিলে দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছি। আমার নির্দেশনা অমান্য করে জন্ম নিবন্ধনের জন্য যদি কেউ টাকা গ্রহণ করে তবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার দোয়ার সবসময় সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত। আবেদন ফরম নিয়ে সরাসরি আমার সঙ্গে দেখা করার অনুরোধ করছি।’
এসআইএইচ