মোংলায় পানি সরবরাহ প্রকল্পে পুকুর চুরি!
মোংলা পৌরসভার পানি সরবরাহ প্রকল্পের পুকুর খননে করা হয়েছে পুকুর চুরি। ৫০ কোটি টাকার পানির প্রকল্পেও হয়েছে ব্যাপক ঘাপলা। এ কারণে যেখানে প্রতিদিন সাড়ে ৩ কোটি লিটার পানি দরকার সেখানে পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৬০ লাখ লিটার।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হলো এই ব্যাপক দুর্নীতি অনুসন্ধানে দুই দফার তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল। দুটি কমিটিই রিপোর্ট জমা দিয়েছে। কিন্তু সেই রিপোর্ট আর আলোর মুখ দেখেনি।
এর ফলে পানির অভাবে একরকম দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন মোংলা পোর্ট পৌরবাসী। রেশনিং পদ্ধতিতে সরবরাহকৃত পানির উপর ভরসা করে কোনোমতে টিকে থাকতে হচ্ছে তাদের।
অনাবৃষ্টি ও চলমান তাপদাহে মোংলা পোর্ট পৌরসভায় পানির সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। শুকিয়ে চৌচির হয়ে গেছে পানি সরবরাহ প্রকল্পের পুকুর। এতে এ পৌরসভার বাসিন্দাদের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সমুদ্র উপকুলীয় অঞ্চল বাগেরহাটের মোংলা উপজেলায় ১৯৭৫ সালে ১৯ দশমিক ৪৩ বর্গ কিলোমিটার আয়তন নিয়ে মোংলা পোর্ট পৌরসভা গঠিত হয়। ধাধে ধাপে এটি এখন প্রথম শ্রেণির পৌরসভায় রূপান্তরিত হয়েছে। সমুদ্র লাগোয়া ও নদী-খাল বেষ্টিত উপজেলা ও পৌর এলাকার এ জনপদে লবনাক্ততার আগ্রাসন প্রায় বছরজুড়েই। চারিদিকে অথৈ পানি থাকলেও পানযোগ্য ও বিশুদ্ধ পানির বড়ই অভাব এখানে।
এ সংকট লাঘবে সরকারিভাবে ২০০৬-২০০৭ সালে মোংলা পোর্ট পৌরসভার পানি সরবরাহ ও এনভায়রোনমেন্টাল স্যানিটেশন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে এককালীন ৮৪ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ফেস-১ ও ফেস-২, এই দুই ভাগে বিভক্ত প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয় ৫০ কোটি টাকা।
২০১২-২০১৩ সালে প্রথম দফায় ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ফেস-১ এর কাজ শুরু হয়। অভিযোগ রয়েছে, এ পর্যায়ে ঘাপলা রেখে দায়সারা শেষ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের অধীনে ২০১২-২০১৩ সালে আরও ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে শুরু হয় প্রকল্পের ফেস-২ এর কাজ। প্রকল্পের ভুমি উন্নয়ন ও সীমানা প্রচীর,পানি শোধনাগার,উচ্চ জলধারা, ইস্পান্ডিং রিজার্ভার নির্মাণ, সাইড ওয়াল নির্মাণ, পাইপ লাইন ও বিদ্যুৎ সংযোগসহ বিভিন্ন প্যাকেজে কাজ করেন একাধিক ঠিকাদার। দৃশ্যমান এ সকল কাজ নিয়ে বিতর্কের অভিযোগ উঠলেও প্রকল্পের পুকুর খননের ঘাপলা ধরা পড়ে প্রকাশ্যে।
প্রকল্পের ফেস-২ এর পুকুর খননে ৭ কোটি ৪৬ লাখ টাকার কাজ পায় মেসার্স মনির ইঞ্জিনিয়ারিং কনেস্টাকশন লিমিটেড। প্রায় ১ লাখ ৪৪ হাজার বর্গফুটের এ পুকুর ১০ ফুট গভীরতার কথা থাকলেও মাত্র সাড়ে ৪ ফুট গভীর খনন করা হয়েছে পুকুরটি।
শুধু তাই নয়, এটি প্রকাশ্য আসার পরও প্রকল্প কর্মকর্তা দ্বিপক চন্দ্র তালুকদার ও আরো ২ জন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে পুরো বিল পরিশোধ করে দেন।
তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত পৌর মেয়র প্রায়ত মোল্ল্যা আব্দুল জলিল এ প্রকল্পসহ নানা দুর্নীতি-অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তার নামে একাধিক মামলা করে।
আর পরবর্তী সময়ে আরেকজন বিএনপি নেতা জুলফিকার আলী মেয়র নির্বাচিত হয়ে টানা ১০ বছর দায়িত্ব পালন করলেও এই দীর্ঘ সময়ে পানি প্রকল্পের ফেস-২ বুঝে নেননি। কাগজে-কলমে বুঝে না নিলেও প্রকল্পের দায়িত্ব পৌর কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
বর্তমান ক্ষমাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র শেখ আব্দুর রহমানও লুটপাট ও অনিয়মের এ প্রকল্পের বুঝে নিচ্ছেন না। এরই মধ্যে বদল হয়েছে তিন জন পৌর মেয়র ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল কয়েকজন কর্মকর্তাও। ফলে বিগত কয়েক বছরেও প্রকল্পটি বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি পৌর কর্তৃপক্ষেকে।
আর এ প্রকল্পটি বুঝিয়ে দেওয়া ও বুঝে নেওয়ার ক্ষেত্রে ঘুরে ফিরে উঠে আসছে নানা অনিয়মের চিত্র। তাই পৌর কর্তৃপক্ষ ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ।
সরকারি প্রতিষ্ঠান জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কেউ কেউ অবসরে চলে গেছেন আবার কেউ কেউ অবসরে যাবেন। এ অবস্থায় একে-অপরের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে যে যার মতো আড়ালে থেকে যাচ্ছেন। আর ভোগান্তি বাড়ছে পৌরবাসীর।
দুর্নীতির কথা স্বীকার করেছেন বর্তমান মেয়র শেখ আব্দুর রহমানও। তিনি জানান, মোংলা পোর্ট পৌরসভায় ৯টি ওয়ার্ডে স্থায়ী বাসিন্দা প্রায় ১২ হাজার আর অস্থায়ী বাসিন্দা প্রায় আরও ৬ হাজার। ১২ হাজার পরিবারের বিপরীতে প্রতিদিন সাড়ে ৩ কোটি লিটার পানির প্রয়োজন। আর ১৮ হাজার পরিবারের জন্য প্রয়োাজন ৪ কোটি ৩০ লাখ লিটার পানি।
পৌর মেয়র জানান, প্রতিদিন গড়ে সকাল-বিকাল ৬০ লাখ লিটার পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। যা চাহিদার তুলনায় খুবই কম। খনন কাজে দুর্নীতির কারণে প্রকল্পের পুকুরে পানি থাকছে না। এ কারণে মিটছে না পৌরবাসীর পানির চাহিদা। এ অবস্থায় একটি মোবাইল ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট দিয়ে প্রতিটি ওয়ার্ডে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। কিন্তু বর্তমান শুষ্ক মৌসুম ও তাপদাহের মধ্যে পানির সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
পৌর এলাকার ৯ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা জলিল হাওলাদার বলেন, সরবরাহের লাইনে পানি আসছে না । তীব্র গরমের মধ্যে নদীর নোনা পানির উপর ভরসা করতে হচ্ছে আমাদের।
পৌর শহরের ৫ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা ফুল মিয়া হাওলাদার বলেন, নদী-খাল বিলসহ চারদিকে অথৈ পানি কিন্তু বিশুদ্ধ পানির বড়ই অভাব। দিন মজুরের কাজে না গিয়ে কলস ও ড্রাম নিয়ে জীবন বাঁচাতে ছোটাছুটি করতে হয় পানির জন্য।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক দ্বিপক চন্দ্র তালুকদার (বর্তমানে অন্যত্র দায়িত্বরত) ঢাকাপ্রকাশ-এর কাছে দাবি করেন, প্রকল্পের সব কিছু ঠিকঠাক আছে। পৌর কর্তপক্ষ বুঝেও নিয়েছেন। পানি সরবরাহও ঠিক আছে ।
মোংলা উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কর্মকবর্তা প্রকৌশলী মো. সোয়ান আহম্মেদ ঢাকাপ্রকাশ-কে জানান, ফেস-২ এর পুকুর খননের ঠিকাদার জামানতের প্রায় ৪ কোটি টাকা ইতিমধ্যে তুলে নিয়েছেন।
এদিকে পৌর এলাকায় ভয়াবহ পানির সংকটের কথা স্বীকার করে তিনি আরও বলেন, শুস্ক মৌসুমের শুরুতে প্রকল্পের পুকুর শুকিয়ে যাচ্ছে। থাকছে না পানি। এ কারণে পৌরবাসির দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। এ অবস্থায় নতুন আরেকটি প্রকল্পের প্রস্তাবনা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে জমা আছে। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে মোংলা পোর্ট পৌরবাসীর পানির সংকট লাঘব হবে।
এসব দুর্নীতি খতিয়ে দেখতে দেখতে প্রথম দফায় খুলনা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তত্বাবধায়ক মো. জামানুর রহমানের নির্দেশনায় সাতক্ষীরা জেলা জনস্বাস্থ্য বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শহীদুল ইসলাম ও যশোর অভয়নগর এলাকার সহকারী প্রকৌশলী মো. মাহামুদুল আলা ২০২২ সালের ২ আগস্ট তদন্ত শুরু করে।
এতে অগ্রগতি না হওয়ায় ওই বছরের ৮ সেপ্টেম্বর ফের তদন্তে নামেন ঢাকা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (পূর্ত) মো. সরোয়ার হোসেন। এ কর্মকর্তা বর্তমানে প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্ব পালন করলেও এখনো আলোর মুখে দেখেনি তদন্ত প্রতিবেদন।
এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. সরোয়ার হোসেন এর ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে কয়েক দফায় যোগাযোগ করা হলেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।
আরইউ/এমএমএ/