ঐতিহাসিক তেলিয়াপাড়া দিবস আজ
আজ ৪ এপ্রিল, ঐতিহাসিক তেলিয়াপাড়া দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে হবিগঞ্জ জেলার তেলিয়াপাড়া চা বাগানে শুরু হয় মুক্তি বাহিনীর কার্যক্রম। এরপরই মুক্তিযোদ্ধারা ঝাপিঁয়ে পড়ে দেশ স্বাধীনতার সংগ্রামে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ৫২ বছর পেরিয়ে গেলেও আজও সরকারিভাবে দিবসটি পালন করা হয় না। শুধু তাই নয় মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার ঐতিহাসিক তেলিয়াপাড়া চা বাগান ব্যবস্থাপকের বাংলোটিকে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর করার আশ্বাস আজও বাস্তবায়ন হয়নি।
৭১’র ২৫শে মার্চ রাতে পাক হানাদার বাহিনী যখন নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর নির্বিচারে হামলা চালায় তখন বিক্ষিপ্তভাবে বাঙালিরা প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে। এক পর্যায়ে প্রতিরোধ যোদ্ধারা একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৭১ সালের ৪ঠা এপ্রিল তেলিয়াপাড়া চা বাগানের বড়ো বাংলোতে ২৭ জন সেনা কর্মকর্তা ও ভারতীয় প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কর্ণেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানীর নেতৃত্বে একটি সুশৃঙ্খল মুক্তি বাহিনী গঠন করা হয়। সারা দেশকে বিভক্ত করা হয় ৪টি সেক্টরে। পরবর্তী ১০ এপ্রিল একই স্থানে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সভায় সেক্টরের সংখ্যা বাড়িয়ে ১১টি করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব সিদ্ধান্ত এসেছিল চা বাগানের এই বাংলো থেকে। স্বাধীনতা যুদ্ধের নকশা প্রণয়ন এবং যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার শপথ গ্রহণ সম্মুখ সমরের পাশাপাশি একটি রাজনৈতিক সরকার গঠনের উপরও গুরুত্বরোপ করাসহ মহান মুক্তিযুদ্ধের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত এখান থেকেই এসেছিল।
জেলার মাধবপুর উপজেলার শাহজাহানপুর ইউনিয়নের চারপাশে চা বাগান বেষ্টিত নির্জন এই স্থানকেই নিরাপদ মনে করেছিলেন স্বাধীনতাকামী ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দেশপ্রেমিক উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ৪ঠা এপ্রিলের ঐতিহাসিক সেই বৈঠকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্ণেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী। এতে আরও উপস্থিত ছিলেন তৎকালীণ কর্নেল এম এ রব, মেজর সি আর দত্ত, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর কে এম সফিউল্লাহ, লে. কর্নেল সালাউদ্দীন মোহাম্মদ রেজা, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর কাজী নুরুজ্জামান, মেজর নুরুল ইসলাম, মেজর শাফায়াত জামিল, মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরী, ক্যাপ্টেন নাসিম, লে. সৈয়দ ইব্রাহীম প্রমুখ। ভারত সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে বৈঠকে অংশ নেন ব্রিগেডিয়ার শুভ্রমানিয়ম, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) পূর্বাঞ্চলীয় মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার ভি সি পান্ডে এবং আগরতলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ওমেস সায়গল। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধি ( এমএনএ) হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করা হয় কর্ণেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী এবং উপ-সর্বাধিনায়ক করা হয় লে. কর্নেল এমএ রব কে। সেই সঙ্গে সভায় তেলিয়াপাড়াকে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সদর দপ্তর ঘোষণা করা হয়। সবশেষে জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী নিজের পিস্তল থেকে শুন্যে গুলি ছুড়ে আনুষ্ঠানিক মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দেন।
ওসমানী ও রবের নেতৃত্বে স্বাধীনতা যুদ্ধের নকশা প্রণয়ন এবং যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার শপথ করানো হয়। শপথ বাক্য পাঠ করান এম এজি ওসমানী। সেই সময় তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের বাংলোটিকে ৩ নম্বর সেক্টরের সদর দপ্তর হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালের ২১ জুনের পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু করে। এর প্রেক্ষিতে তেলিয়াপাড়া চা-বাগান থেকে ওই কার্যালয় সরিয়ে নেওয়া হয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা মিশে আছে এই তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের বাংলোয়। হানাদার বাহিনীর সঙ্গে বেশ কিছু রক্তক্ষয়ী সম্মুখ যুদ্ধেরও সাক্ষী বাংলোটি। পাক হানাদার বাহিনী বারবার এই এলাকার দখল নিতে এসে মুক্তি বাহিনীর হাতে মার খেয়ে পিছু হটার সময় তেলিয়াপাড়া গ্রাম ও বাজারে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যা চালায়। কিন্তু ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটি আজও তেলিয়াপাড়া চা-বাগানের ব্যবস্থাপকদের বাংলো হিসেবেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
২,৩ ও ৪ নম্বর সেক্টরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে বাংলোর পূর্ব-দক্ষিণ কোণে নির্মিত হয়েছে তেলিয়াপাড়া স্মৃতিসৌধ। ১৯৭৫ সালের জুন মাসে স্মৃতিসৌধটি উদ্বোধন করেন সাবেক সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ। স্মৃতিসৌধের ফলকে ৩৩ জনের নামের তালিকায় রয়েছে রাজনৈতিক নেতা, সাবেক সেনা ও সরকারি কর্মকর্তা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নাম। এর মধ্যে রয়েছে প্রথম সেনাপ্রধান কর্ণেল আতাউল গণি ওসমানী, সহ-সেনাপ্রধান লে. কর্ণেল আব্দুর রব এমএনএ, মেজর কে.এম সফিউল্লাহ (সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া), মেজর খালেদ মোশাররফ (কুমিল্লা-নোয়াখালি), মেজর জিয়াউর রহমান (চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রাম) ও মেজর আবু ওসমান চৌধুরী (কুষ্টিয়া-যশোহর পশ্চিম রনাঙ্গন)।
চা-বাগানের সবুজের বেষ্টনীতে স্মৃতিসৌধ ছাড়াও আছে একটি প্রাকৃতিক হৃদ। লাল–শাপলা ফোটা এই হৃদ বর্ষাকালে অপরূপ হয়ে উঠে। স্মৃতিসৌধ থেকে একটু সামনে এগিয়ে গেলেই ঐতিহাসিক বাংলোটি। স্থানীয় জনগণ বহুকাল ধরেই মুক্তিযুদ্ধের জন্য তাৎপর্যময় বাংলোটিতে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর তৈরির দাবি করে আসছে, তবে তা বাস্তবায়ন হয়নি আজো! ভবিষ্যতে কখনো বাস্তবায়ন হবে কিনা সে ব্যাপারেও রয়েছে ব্যাপক সন্দেহ।
১৯৭১ সালের ১৬ মে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ তফাজ্জল হোসেন চৌধুরীর নাতি ও শহীদ বদরুল হোসেন চৌধুরীর ভাতিজা শিক্ষক নয়ন চৌধুরী বলেন, ‘তেলিয়াপাড়া বাংলোটি আমাদের গর্বের, বহু ত্যাগের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সাক্ষী। এটি এখনও মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের অধীনে আসেনি। এখনও সেটি তেলিয়াপাড়া চা–বাগানের ব্যবস্থাপকের বাংলো হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে।’
বাংলোটির নিয়ন্ত্রণ সরকারের কাছে নিয়ে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
বীর মুক্তিযুদ্ধা এনাম খান বলেন, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা এখানে এসে যাদুঘর হবে বলে আশ্বাস দিয়ে যায় কিন্তু এখনো কিছু হচ্ছে না। আমাদের দাবি, এখানে যাদুঘর নির্মাণ করে মুক্তিযুদ্ধের এখানকার স্মৃতিগুলো সংরক্ষণ করা হোক। প্রতি বছর সরকারিভাবে ৪ এপ্রিল বৃহৎ পরিসরে যেন পালন করা হয়।
তিনি আরও জানান, মাধবপুর উপজেলার ১৯০ জন মুক্তিযুদ্ধা জীবিত আছেন। যাদের বেশির ভাগ বয়সের কারণে অসুস্থ ও দুর্বল হয়ে পড়েছেন। পবিত্র রমজান মাসে রোজা রেখে অনুষ্ঠানে আসাটা কষ্টকর হয়ে যাবে উনাদের জন্য। তাই এই বছর ৪ঠা এপ্রিলে কোনো সভা-সমাবেশ করা হবে না। সকালে উপজেলা প্রশাসনকে সাথে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধারা তেলিয়াপাড়া স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও দোয়ার আয়োজন করা হয়েছে।
এসআইএইচ